কোণার্ক বা কোণারক (ওড়িয়া: କଣାର୍କ Koṇārka) ওড়িশার উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট শহর। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই শহরটির অবস্থান ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে। মূলত ১৩ শতকে নির্মিত প্রাচীন সূর্য মন্দির এবং চন্দ্রভাগা নদীর জন্য এই শহর বিখ্যাত।
পরিচিতি
[সম্পাদনা]
কোণার্ক শহর কোণাদিত্য নামেও পরিচিত। "কোণার্ক" শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে কোণ (অর্থাৎ "প্রান্ত"/"কোণা") এবং অর্ক (অর্থাৎ "সূর্য") - এই দুই শব্দের সমন্বয়ে, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় "সূর্যের কোণ"। এই শহর পুরী বা চক্রক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। কোণার্কের সূর্য মন্দির "ব্ল্যাক প্যাগোডা" নামেও পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দী মাঝামাঝি সময়ে গঙ্গা বংশের রাজা প্রথম নরসিংহ দেব এই মন্দির নির্মাণ করেন, যা সেই সময়কার শিল্পগৌরবের এক অনন্য নিদর্শন। সমগোত্রীয় অন্যান্য মন্দিরের সাথে তুলনা করার সময় কোণার্কের সূর্য মন্দিরকে প্রায়শই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়, বিশেষত যখন "ওড়িশার স্বর্ণ ত্রিভুজ" সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। কোণার্কের সূর্য মন্দির, পুরীর জগন্নাথ মন্দির এবং ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরকে একত্রে "ওড়িশার স্বর্ণ ত্রিভুজ" আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
কোণার্ক শহর ক্রান্তীয় জলবায়ুর অধীন, ফলে এখানে বেশিরভাগ সময়েই উচ্চ তাপমাত্রা অনুভূত হয়।
কোণার্কের কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, কৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র সাম্ব কৃষ্ণের স্ত্রীদের স্নানাগারে প্রবেশ করেছিলেন। সেইজন্য কৃষ্ণ তাঁকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দেন। অভিশাপ মুক্তির জন্য শাম্বকে পুরীর উত্তর-পূর্ব সমুদ্রতটে সূর্যদেবের পূজা করার নিদান দেওয়া হয়।
প্রচলিত ধারনা থেকে জানা গেছে যে, পরিকল্পনা অনুসারে মন্দিরের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করা যায়নি, কারণ এর ভিত্তি ভারী গম্বুজের ওজন বহন করার মতো শক্তিশালী ছিল না। মন্দির এবং এর নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাহিনিতে মন্দিরে উপস্থিত এক বিশাল শক্তির আভার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মনে করা হয়, এই বিশাল শক্তির কারণ ছিল দুটি শক্তিশালী চুম্বক যা মন্দিরের স্তম্ভ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল। চুম্বকের প্রভাবে সূর্যদেবের সিংহাসন বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকত।
মন্দিরে স্থাপিত চুম্বকের কারণে সমুদ্রপথে গমনকারী জাহাজগুলি যখন কোণার্কের তটরেখার নিকটে আসত তখন সেগুলি মন্দিরের দিকে আকৃষ্ট হতো, যার ফলে জাহাজগুলির বড় ধরনের ক্ষতি হতো। অন্য এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, মন্দিরে স্থাপিত চৌম্বকীয় পাথর (লোডস্টোন)-এর প্রভাবে জাহাজের দিকনির্দেশক যন্ত্র (কম্পাস) বিকল হয়ে যেত এবং সঠিকভাবে কাজ করত না। পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা তাদের নৌযান রক্ষা করার জন্য পাথরটি সরিয়ে নিয়ে যায়। এই চৌম্বকীয় পাথর মন্দিরের সমস্ত লোহার স্তম্ভগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। পাথরটি সরিয়ে নেওয়ার পর মন্দিরের দেয়ালগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তা ধসে পড়ে। তবে এই ঘটনার কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই এবং কোণার্কে এমন শক্তিশালী লোডস্টোনের অস্তিত্বেরও কোনো প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না।
সূর্য মন্দিরের স্থাপত্য
[সম্পাদনা]সূর্য মন্দির ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর ধর্মীয় স্থাপত্যস্মারক। বিশাল এই নির্মাণ বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়ে, একাকী বালির স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে এটি সমুদ্র থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, কিন্তু প্রাচীনকালে মন্দিরের ভিত্তি প্রায় সমুদ্র উপকূল অবধি প্রসারিত ছিল। আসলে বেশ কিছুদিন আগেও মন্দিরটির অবস্থান ছিল উপকূলের বেশ কাছে। সেসময় ইউরোপীয় নাবিকেরা এই মন্দিরকে দিকনির্দেশনার জন্য ব্যবহার করতেন। তারা এই মন্দিরকে 'ব্ল্যাক প্যাগোডা' নামে অভিহিত করতেন।
কোণার্ক সূর্য মন্দিরের গঠনশৈলী মধ্যভারতের মন্দির স্থাপত্যরীতির অন্তর্গত। তবে আগামী সময়ে ওড়িশা ও মধ্যভারতে নির্মিত মন্দিরে যেমন উঁচু শিখর থাকত, সেরকম কিছু এই মন্দিরে ছিল না।
আঞ্চলিক ভাষা
[সম্পাদনা]এখানকার স্থানীয় মানুষ অতিথিপরায়ণ। তারা ওড়িয়া ভাষার পাশাপাশি হিন্দি ও বাংলা ভাষাও বোঝে। স্থানীয় মানুষ ইংরেজি ভাষা বুঝলেও খুব বেশি ব্যবহার করেন না।
কিভাবে আসবেন
[সম্পাদনা]কোণার্ক ওড়িশার অন্যতম প্রধান শহর এবং একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটনস্থল, বিশেষত ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত পর্যটকদের জন্য। কোণার্কে পৌঁছানোর সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হলো পুরী (৩৩ কিমি) অথবা ভুবনেশ্বর (৬৫ কিমি) থেকে গাড়ি চালিয়ে আসা। কোণার্ক ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।
বিমানে
[সম্পাদনা]নিকটতম বিমানবন্দরটি ভুবনেশ্বরে (বিবিআই আইএটিএ) অবস্থিত, যার দূরত্ব প্রায় ৬৪ কিলোমিটার। কলকাতা , দিল্লি , হায়দ্রাবাদ , চেন্নাই , ব্যাঙ্গালুরু এবং নাগপুর থেকে সরাসরি বিমানে ভুবনেশ্বর আসা যায়।
ট্রেনে
[সম্পাদনা]কোণার্কের নিকটতম রেলওয়ে স্টেশনগুলি হল পুরী এবং ভুবনেশ্বর। এই দুই স্টেশন ভারতের সমস্ত প্রধান গন্তব্যস্থলের সাথে রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত।
গাড়িতে
[সম্পাদনা]জাতীয় ও রাজ্য সড়কগুলি কোণার্ককে পুরী ও ভুবনেশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কোণার্ক, পুরী ও ভুবনেশ্বর জনপ্রিয়ভাবে পূর্ব ভারতের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল বা প্রাচ্যের স্বর্ণ ত্রিভুজ নামে পরিচিত। ভুবনেশ্বর থেকে কোণার্ক যেতে হলে প্রথমে ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পিপিলিতে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে বাঁদিকে মোড় নিয়ে সোজা রাস্তা ধরে আপনি পুরীতে পৌঁছে যাবেন।
পুরী ও কোণার্কের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করা সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়। এই দুই শহর থেকে প্রচুর পরিবহন বাস এবং বেসরকারি কোচ চলাচল করে। ভুবনেশ্বরের বাস স্ট্যান্ড, বাণী বিহার এবং কল্পনা চকের থেকেও কোণার্কগামী রাষ্ট্রীয় বাস পাওয়া যায়। গাড়ি ভাড়ার তুলনায় বাসে ভ্রমণ করা অনেক বেশি সাশ্রয়ী। যদিও এই বাসগুলি ভিড়পূর্ণ ও অস্বস্তিকর, তবুও এগুলো ওড়িশার দৈনন্দিন জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে। বাসের ভাড়া ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৮০ টাকা (প্রায় ১ ডলার)।
কিভাবে ঘুরবেন
[সম্পাদনা]শহরের ভিতরে ঘোরাঘুরির জন্য অটো-রিকশা, ট্যাক্সি এবং সাইকেল রিকশা উপলব্ধ রয়েছে। সস্তায় ভ্রমণ করতে চাইলে আপনি রাজ্য পরিবহন দপ্তরের বাসে চড়ে যাতায়ত করতে পারেন। তবে এই বাসগুলি কিছুটা জরাজীর্ণ এবং অস্বস্তিকর। তবে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ও খরচের অনুপাতে হিসাব করলে এই বাসযাত্রা খুবই সাশ্রয়ী।
সমুদ্র উপকূল বরাবর পুরী থেকে কোণার্কের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। পুরী থেকে কোণার্ক অবধি নিয়মিত বাস এবং গাড়ি চলাচল করে। যাতায়ত করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। পুরীতে ফেরার বাস সকাল ৬:৩০ টায় ছাড়ে। কোণার্ক ভ্রমণের জন্য আপনি একটি অটো-রিকশাও ভাড়া নিতে পারেন। পুরী থেকে যাওয়া, আসা এবং বিরতির সময় (যখন আপনি দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করবেন এবং অটো-রিকশা আপনার জন্য অপেক্ষা করবে) - এই সব মিলিয়ে খরচ পরে ২৫০–৩০০ টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়)।
ভুবনেশ্বরের পান্থনিবাস (ওড়িশা পর্যটন দপ্তরের অধীন) থেকে ওড়িশা সরকার কোণার্ক ভ্রমণের আয়োজন করে। প্রতি মঙ্গলবার থেকে রবিবার সকাল ৬:৩০ টায় সফরের সূচনা হয়। জনপ্রতি খরচ ভারতীয় মুদ্রায় ১৩০ টাকা। এই সফরে ধৌলি দর্শনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
দ্রষ্টব্য
[সম্পাদনা]এই স্থানের প্রধান আকর্ষণ হলো কোণার্ক সূর্য মন্দির, যা ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে। মন্দিরটি পুরীর উত্তরে কোণার্ক গ্রামে, বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। মন্দিরের দেয়ালে বিস্তৃত পাথরের কারুকার্য খোদাই করা হয়েছে, যার মধযেমধ্যে অনেক কামোত্তেজক ভাস্কর্যও আছে। যদিও প্রবল ক্ষয়প্রক্রিয়ার ফলে মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, তবুও এর স্থাপত্যশৈলীতে আজও সেই মহিমা প্রতিফলিত হয়।
কোণার্ক সূর্য মন্দির
[সম্পাদনা]
- 1 কোণার্ক সূর্য মন্দির। ১৩শ শতকে ভগবান সূর্যদেবের সম্মানে নির্মিত এই মন্দির একটি
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃত। বর্তমানে মন্দিরটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল একটি বিশাল রথের আকৃতিতে, যার ২৪টি চাকা এবং প্রতিটি চাকার উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার। সাতটি ঘোড়া সেই রথ টেনে নিয়ে যায়। বৈদিক যুগ থেকেই ভারতে সূর্যদেবের পূজার প্রচলন রয়েছে। - মন্দির প্রাঙ্গণের পরিমাপ হলো ৮৫৭ বাই ৫৪০ ফুট (অথবা ২৬১ বাই ১৬৫ মিটার)। সূর্য মন্দিরের অবস্থান পূর্ব–পশ্চিম দিক বরাবর।
- সমগ্র মন্দিরটি এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের গাত্রে বারো জোড়া সুদৃশ্য পাথরের চাকা খোদাই করা হয়েছে। মন্দিরের গাত্রে অলংকৃত পাথরের ঘোড়াগুলোর বিন্যাস এমন যে সেগুলি দেখলে মনে হয় মন্দিরের গর্ভগৃহে আসীন সূর্যদেব (সূর্য) স্বয়ং এই মন্দিররূপী রথ চালনা করছেন।
- মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বারের অবস্থান পূর্ব দিকে, সমুদ্রের অভিমুখে। এই প্রবেশদ্বারটি ভোগমণ্ডপের সম্মুখভাগে অবস্থিত, যা উপহার সভা নামেও পরিচিত। এই সভাগৃহের দেয়ালে নৃত্যশিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের ভাস্কর্য খোদাই করা আছে। পরে এই স্থানটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
- মন্দিরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত পবিত্র স্তম্ভটি বর্তমানে বেলেপাথরের স্তূপে পরিণত হয়েছে। এই চমৎকার নির্মাণের উপর এক সময়ে একটি পিরামিড আকৃতির ছাদ ছিল, যা সাধারণত জগন্মোহন নামে পরিচিত।
- জগন্মোহনের ছাদে প্রায় তিনটি স্তর রয়েছে এবং প্রতিটি স্তরে বহু ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলো মূলত নৃত্যশিল্পী বা সংগীতশিল্পীদের। সবচেয়ে নিচের স্তর বা ভিত্তিতে নটরাজরূপী শিবের নৃত্যরত মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। বর্তমানে ছাদের অভ্যন্তরভাগ ফাঁকা ও পরিত্যক্ত।
- ছাদের পরবর্তী অংশে যে সিঁড়িগুলি আছে সেগুলি অনুসরণ করে সূর্যদেবের মূর্তির সম্মুখে পৌঁছানো যায়। সূর্যদেবের এই মূর্তি বিশাল সবুজ রঙের ক্লোরাইট পাথর খোদাই করে নির্মিত হয়েছে। এটি কোণার্কের সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে জগন্মোহনের প্রবেশদ্বারটি বর্তমানে বন্ধ, কারণ ছাদ থেকে প্রায়ই ধ্বংসাবশেষ ও পাথর খসে পড়ে।
কোণার্ক মন্দির ওড়িশার মন্দির নির্মাণশৈলীর চূড়ান্ত পরিণতির প্রতীক। বিশাল সূর্যরথের অলঙ্কৃত পাথরের চাকা ও সজ্জিত ঘোড়ার চিত্রায়ন -এই সমস্ত কিছু নিয়ে কোণার্ক মন্দির ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের একটি আদর্শ উদাহরণ। এই মন্দির অন্যান্য আঞ্চলিক মন্দিরগুলোর তুলনায় খুব একটা ভিন্ন নয়।
- পূর্বদিকে অবস্থানকারী মন্দির প্রাঙ্গণের প্রধান প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি গজসিংহ (হাতির উপর সিংহ) মূর্তি অবস্থিত। গজসিংহের মুখাবয়ব বহির্মুখী এবং তারা দুটি উঁচু পাথরের আসনের উপর স্থাপিত।

- কোণার্ক মন্দিরে অলঙ্কৃত রথের চাকারও প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। এই চাকাগুলিকে ‘জীবন চক্র’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং আত্ম উপলব্ধির ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে। প্রায় ৯ ফুট (২.৭৩ মিটার) ব্যাসের প্রতিটি চাকা আটটি সমান ভাগে বিভক্ত। চাকা জুড়ে সূক্ষ্ম খোদাই করা হয়েছে। মোটা চাকার কেন্দ্রস্থলে সবচেয়ে প্রশস্ত অংশে বৃত্তাকার চিহ্ন খোদাই করা হয়েছে। চাকার অক্ষগুলি পৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক ফুট বহির্মুখী এবং তাদের প্রান্তেও অনুরূপ অলঙ্করণ রয়েছে। চাকার পরিধি বরাবর পাতার নকশা, বিভিন্ন পাখি ও প্রাণীর চিত্র খোদাই করা হয়েছে এবং অক্ষের গোলাকৃতি অংশে বিভিন্ন বিলাসবহুল ভঙ্গিমায় নারীমূর্তি খোদাই করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই কামোত্তেজক প্রকৃতির।
- জগন্মোহনের সামনে অবস্থিত নাটমন্দিরে নৃত্যশিল্পী, ফুল ও পাতার নকশা, বর্মধারী পুরুষ এবং সৃজনশীল কামোত্তেজক ভাস্কর্য অত্যন্ত নিপুণভাবে খোদাই করা হয়েছে।
- উপরের অংশে সূর্যদেবের তিনটি মূর্তি (পূর্বে চারটি ছিল) স্থাপন করা হয়েছে। মুর্তিগুলির অবস্থান ও অভিমুখে এমনই যে দিনের বিভিন্ন সময়ে (ভোর, মধ্যাহ্ন এবং সূর্যাস্তের সময়) একটি নির্দিষ্ট মূর্তিতেই সূর্যের রশ্মি আপতিত হয়।
- জগন্মোহনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের সিঁড়ির পার্শ্বপ্রাচীরে যে হাতির মূর্তিগুলি একসময় স্থাপন করা ছিল, সেগুলো ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
- প্রথম কুলোত্তুঙ্গ চোল (১০৭৫–১১২০)–এর সময়ে নির্মিত মেলাক্কাডম্বুর শিব মন্দিরটি রথের আকারে নির্মিত প্রথম মন্দির, এবং এটি এখনও ভালোভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
- মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে একটি ছোট সংগ্রহশালা রয়েছে, যা ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ দ্বারা পরিচালিত। এখানে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্য সংরক্ষিত আছে। এটি শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশ একেবারে বিনামূল্যে।
- সূর্য মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবী রামচণ্ডীর একটি মন্দির রয়েছে। তবে এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কে ছিলেন, সে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি সূর্যদেবের স্ত্রী মায়াদেবীর মন্দির ছিল, আবার অন্যদের মতে এটি সূর্যদেবের প্রাচীন মন্দির, যেখানে সূর্যদেবের পূজা হতো।
- সকাল ৬টায় যখন গেট খোলে, তখনই মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করুন। এই সময়ে মন্দিরটি সবচেয়ে শান্ত ও মনোমুগ্ধকর থাকে। মন্দির প্রাঙ্গণে সূর্যোদয়ের নাটকীয় দৃশ্যের মাঝে ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য। দেশীয় পর্যটকদের ভিড় সাধারণত সকাল ৮:৩০টার দিকে শুরু হয় এবং তারা প্রায় সারাদিনই সেখানে ঘুরে বেড়ান।
অন্যান্য আকর্ষণ
[সম্পাদনা]কোণার্ক সূর্য মন্দির এই অঞ্চলের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। যদি আপনি কোণার্কে একটি পূর্ণ দিন কাটাতে চান, তাহলে কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানেও যেতে পারেন। সময় না থাকলে সেগুলি আপনার সফরসূচী থেকে বাতিল করুন, নাহলে কিছু নির্বাচিত স্থান পরিদর্শন করুন। যদি আপনি ওটিডিসি (ওড়িশা পর্যটন দপ্তর) বা বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থার অধীনে ভ্রমণ করেন, তাহলে সাধারণত বাস চালকেরা এই গন্তব্যগুলোর কথা উল্লেখ করেন অথবা যাত্রার সময় প্রায় এক ঘণ্টার জন্য এই স্থানগুলোতে বিরতি নেন।
|
রামচণ্ডীর লোককাহিনী
কোণার্ক ক্ষেত্রের প্রধান দেবী হিসেবে রামচণ্ডীকে ঘিরে বহু জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত রয়েছে এবং সম্ভবত এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন রামচণ্ডী। একটি জনপ্রিয় কাহিনিতে উল্লেখ আছে, যখন মুসলিম সেনাপতি সুলেমান কালাপাহাড় সূর্য মন্দির ধ্বংস করেন, তখন কেন রামচণ্ডী দেবী কোণার্ক ত্যাগ করেছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সূর্য মন্দির ধ্বংস করার পর কালাপাহাড় সূর্য মন্দিরের পিছনে, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রামচণ্ডীর মন্দিরে পৌঁছান। তখন দেবী রামচণ্ডী মালুনি (দাসী)-র বেশে এসে কালাপাহাড়কে অনুরোধ করলেন যে, যতক্ষন না তিনি দেবীর জন্য জল নিয়ে ফিরে আসছেন ততক্ষন সে যেন দরজায় অপেক্ষা করে। কালাপাহাড় ঠান্ডা জল পাওয়ার আশায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করেন, তখন দেখেন সিংহাসনটি খালি। কালাপাহাড় ভাবলেন যে মালুনি দেবীকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাই তিনি রেগে গিয়ে মালুনিকে অনুসরণ করেন। কুশভদ্রা নদীর তীরে পৌঁছানোর পর তিনি দেখেন দেবী রামচণ্ডীর মূর্তি নদীর মাঝখানে ভেসে রয়েছে। নদী তখন পূর্ণ প্রবাহে ছিল, ফলে তিনি নদী পার হতে না পেরে ফিরে আসেন। পরে স্বপ্নে দেবীর নির্দেশে এক পাণ্ডা (পুরোহিত) কুশভদ্রা নদীর তীরে, সমুদ্রের কাছাকাছি একটি বালুকাময় নির্জন স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। |
- 2 চন্দ্রভাগা সৈকত (সূর্য মন্দিরের ৩ কিমি পূর্ব দিকে)। চন্দ্রভাগা সৈকত সামুদ্রিক সম্পদে ভরপুর। চন্দ্রভাগার কাছাকাছি একটি বাতিঘর রয়েছে, যা এই স্থানের সৌন্দর্যে একটি নাটকীয় মাত্রা যোগ করেছে। এর চূড়ায় ওঠা এক স্বপ্নময় জগতে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা। এখানে সম্প্রতি একটি প্রাকৃতিক হরিণ উদ্যান গড়ে উঠেছে, যা চন্দ্রভাগার ঐশ্বর্যে নতুন সংযোজন। এখানে একটি প্রাচীন মঠ রয়েছে, যা চন্দ্রভাগার পিতার আশ্রম হিসাবে পরিচিত। এছাড়াও দুটি ছোট মন্দিরও আছে। এই স্থানটি নান্দনিকতা ও গুরুত্বে ভরপুর।
- কুরুমা (সূর্য মন্দির থেকে ৮ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে)। একটি জনপ্রিয় বৌদ্ধ তীর্থস্থান, যা ৯ম–১০ম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে পরিত্যক্ত এই বিহারে একটি উৎখননকৃত বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এই মূর্তিতে বুদ্ধ পদ্মাসনে বসে আছেন, ডান হাত ভূমিস্পর্শ মুদ্রায়, আর বাম হাত বাম হাঁটুর উপর স্থাপিত। মূর্তিটির মস্তকে একটি সুন্দর মুকুট রয়েছে, যাতে সূক্ষ্ম খোদাই করা অলঙ্করণ দৃশ্যমান।
|
দেবী মঙ্গলা ও নবকলেবর
পুরীর দেবমূর্তিগুলোর সংস্কারের সময়, ভগবান জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার জন্য নতুন প্রতিমা তৈরি করা হয়। এই নতুন প্রতিমাগুলি স্থানীয় ভাষায় 'দারু ব্রহ্ম' নামে পরিচিত এক পবিত্র কাঠ থেকে নির্মিত হয়। কিন্তু কেউ জানে না এই পবিত্র কাঠ কোথায় পাওয়া যাবে। তাই প্রথা অনুযায়ী, জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতরা কাকতপুরের দেবী মঙ্গলার কাছে প্রার্থনা করেন, যাতে তিনি তাঁদের কাঙ্ক্ষিত কাঠের সন্ধান দিতে সাহায্য করেন। পুরোহিতরা দেবীর সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন, এবং তখন দেবী মঙ্গলা তাঁদের স্বপ্নে এসে তিনটি দেবতার জন্য নির্দিষ্ট তিনটি পবিত্র বৃক্ষের অবস্থান জানিয়ে দেন। এই রীতি আজও অবিকৃতভাবে পালিত হয়ে আসছে |

- 3 রামচণ্ডী মন্দির (সূর্য মন্দির থেকে ৭ কিমি দূরে)। রামচণ্ডীকে সাধারণভাবে কোণার্কের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে গণ্য করা হয়। স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে রামচণ্ডীর মন্দিরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত। চন্দ্রভাগা সমুদ্রতটের কাছে অবস্থিত এই মন্দির স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের অবকাশস্থল। এছাড়াও, স্থানীয় পরিবারের লোকেরা সপ্তাহান্তে এখানে বনভোজন করেন। তাই স্থানটি জনবহুল থাকে। প্রধান মন্দিরটি এবং তার মুখশালা একটি ৩ ফুট ২ ইঞ্চি (৯৬.৫ সেমি) উঁচু ভিতের উপর নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর—এই তিন পাশে সূর্যদেবের তিনটি পার্শ্বদেবতার মূর্তি স্থাপন করা ছিল। বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে এই পার্শ্বদেবতাদের দেখা যায়, তবে পশ্চিম পাশের মূর্তিগুলি স্থানচ্যুত হয়েছে এবং নয়াদিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলির মধ্যে একটি বিশেষ ভাস্কর্যশৈলী লক্ষ্য করা যায় এবং এটি সূর্যদেবের অন্যতম সুন্দর মূর্তি হিসেবে বিবেচিত। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের মন্দিরের পার্শ্বদেবতার মূর্তির সাথে সূর্য মন্দিরের পার্শ্বদেবতাদের গঠনশৈলীর মিল দেখা যায়। উত্তর পাশের মূর্তিগুলি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে, কিন্তু দক্ষিণ পাশের মূর্তিটির মাথা নেই এবং হাত ভাঙা।
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
[সম্পাদনা]যদিও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ (এএসআই) এই মহিমান্বিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পুনরুদ্ধারে কাজ করছে, তবুও ওড়িশার বিভিন্ন মহল থেকে সূর্য মন্দিরের অবনতিশীল অবস্থাকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রচলিত কিংবদন্তিতে বলা হয়, সূর্য মন্দিরের শিখরে একটি লোডস্টোন (চুম্বক) স্থাপন করা ছিল। এর চৌম্বকীয় প্রভাবে কোণার্ক সাগর দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজগুলো মন্দিরের দিকে আকৃষ্ট হতো, যার ফলে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হতো। অন্য একটি কাহিনিতে বলা হয়েছে, লোডস্টোনের চৌম্বকীয় প্রভাবে জাহাজের কম্পাস বিকল হয়ে যেত এবং সঠিকভাবে কাজ করত না। নিজেদের জাহাজগুলি রক্ষা করার তাগিদে পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা চুম্বকটি সরিয়ে নিয়ে যায়। এই চুম্বক মন্দিরের সমস্ত পাথর ও লোহার স্তম্ভগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। পাথরটি সরিয়ে নেওয়ার ফলে মন্দিরের দেয়ালগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তা ধসে পড়ে। তবে এই ঘটনার কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই এবং কোণার্কে এমন শক্তিশালী লোডস্টোনের অস্তিত্বেরও কোনো প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি।
কোণার্ক সুরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে ১৩ শতকের নির্মিত এই স্থাপত্য থেকে পাথর খসে পড়া এখন "নিয়মিত ঘটনা" হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই মন্দির থেকে বড় বড় পাথরের খণ্ড খসে পড়ছে। ১৯৯৮ সালে জগমোহনের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে একটি দুই টন ওজনের পাথর খসে পড়ে। ১৯৫১ সাল থেকে জগমোহনের অভ্যন্তরভাগ বদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং সেই বছরেই প্রথম গুরুত্ব সহকারে মন্দির সংরক্ষণ করার কাজ শুরু হয়। মন্দিরের দেয়ালগুলোকে ভিতর থেকে ঠেস দিয়ে শক্ত করা হয় এবং অভ্যন্তরভাগে বালি ভর্তি করে ধস ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। সেসময় মন্দিরের অবস্থা ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর।
এএসআই কর্মকর্তারা বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ তাতে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়তে পারে।
কি করবেন
[সম্পাদনা]কোণার্ক শুধু তার স্মৃতিস্তম্ভ, সমুদ্রতট ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং তার বর্ণময় উৎসবের জন্যও একটি আদর্শ গন্তব্য। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত “কোণার্ক উৎসব” সাংস্কৃতিক অনুরাগীদের জন্য এক অনবদ্য আকর্ষণ। কোণার্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও রঙিন উৎসবটি মাঘ মাসের অমাবস্যার সপ্তম দিনে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ভারতীয় তীর্থযাত্রী ও বিদেশি উৎসাহী দর্শনার্থীদের এক মহাসমাবেশ ঘটে।
বেশিরভাগ পর্যটকই পুরী বা ভুবনেশ্বর থেকে এক দিনের জন্য কোণার্ক ভ্রমণ করে ফিরে যান, কারণ সেখানে রাত কাটানোর চেয়ে এটি অনেক বেশি সুবিধাজনক। সাধারণত ভ্রমণকারীরা পুরী থেকে যাত্রা শুরু করে একই দিনে ভুবনেশ্বর ও কোণার্ক ঘুরে দেখেন। তবে নগরের কোলাহল থেকে একটু বিরতি নিতে চাইলে, কোণার্ক নিঃসন্দেহে শান্তি উপভোগের জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান।
- আলোক ও শব্দ প্রদর্শনী, কোণার্ক সূর্য মন্দির প্রাঙ্গণ।
রাত ৮টা-রাত ৮:৪০টা(সন্ধ্যা ৭:৩০ টায় প্রবেশ)। কোণার্ক সূর্য মন্দির প্রাঙ্গণে একটি আলো ও শব্দের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন মন্দিরের পটভূমির উপর আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে এবং শব্দের মাধ্যমে মন্দিরের সম্পূর্ণ ইতিহাস ও কলিঙ্গ ইতিহাসের অংশবিশেষ দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়। প্রদর্শনীর সময় ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৫০ টাকা(ভারতীয় মুদ্রায়)।
চন্দ্রভাগা মেলা
[সম্পাদনা]ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত চন্দ্রভাগা মেলা কোণার্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব। এই দিনটি সূর্যদেবের পূজার জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী কোণার্কে সমবেত হন। তারা চন্দ্রভাগা নদীতে পবিত্র স্নান করেন এবং তারপর মন্দির বা জগমোহনের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে পূজা দেন নবগ্রহ শিলার, যা একসময় পূর্বদ্বারের উপরে স্থাপিত ছিল। বর্তমানে এই শিলা মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে একটি ছোট ছাউনির নিচে রাখা হয়েছে।
এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বর্ণময় ও জনসমাগমপূর্ণ উৎসব, যেখানে লক্ষাধিক তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়। প্রকৃতপক্ষে, পুরীর রথযাত্রার পরে এটিই ওড়িশার দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব।
কোণার্ক নৃত্য উৎসব
[সম্পাদনা]এখানকার আরেকটি বর্ণময় উৎসব হলো কোণার্ক নৃত্য উৎসব, যা ভারতের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই উৎসবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্যাতনামা শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন এবং কোণার্ক সূর্য মন্দিরের পটভূমিতে খোলা আকাশের নিচে সরাসরি দর্শকদের সামনে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই উৎসব ওড়িশার অনন্য মন্দির-নৃত্য ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, সংরক্ষণ এবং ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী উদ্যোগের জন্য বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা অর্জন করেছে।
কেনাকাটা
[সম্পাদনা]মন্দির দর্শনের পাশাপাশি কোণার্কে আপনি কেনাকাটা করার মতো অনেক কিছুই পাবেন। কোণার্ক শহরের বাজারে পায়ে হেঁটে ঘুরে আপনি পছন্দমতো জিনিস কিনতে পারেন।
এখানকার স্থানীয় আকর্ষণ হল পিপলির পটচিত্র, অ্যাপ্লিকের কাজ এবং চমৎকার সূচিকর্ম দ্বারা সজ্জিত ছাতা, যেগুলি আপনি সংগ্রহ করতে পারেন। যদি আপনি স্মারক বা উপহার কিনতে চান, তাহলে সরকারি দোকানই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এখানে ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বস্ত্র ও হস্তশিল্প সামগ্রী পাওয়া যায়।
স্থানীয় বাজার বা দোকানে সস্তায় ঝিনুক ও শঙ্খ বিক্রি হয়, যা আকর্ষণীয় স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। তবে কেনার সময় দোকানদারদের সঙ্গে দরাদরি করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ দোকানদাররা ক্রেতাদের দর কষাকষির অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন, তাই তারা আগে থেকেই দ্বিগুণ দর হাঁকেন।
- পিপলি (সূর্য মন্দির থেকে ২৩ কিমি দূরে)। এই ছোট গ্রামটিতে স্থানীয় হস্তশিল্পের বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ রয়েছে। পিপলির প্রধান সড়কে অনেক দোকান রয়েছে, যেখানে অ্যাপ্লিকের কাজের পণ্য বিক্রি হয়। পুরী ভ্রমণকারী পর্যটকরা পিপলিতে এসে এই সব পণ্য কেনাকাটা করেন।
খাদ্য ও পানীয়
[সম্পাদনা]সমুদ্র সৈকত এবং মন্দির চত্বরের কাছে অবস্থিত প্রধান বাজার এলাকায় নিরামিষ এবং আমিষ উভয় ধরনের খাবার পাওয়া যায়। খাবারের জন্য অনেক স্থানীয় ধাবা (খাবারের দোকান) রয়েছে। স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি, বাঙালি রীতিতে তৈরি ভাজা মাছও চেখে দেখতে পারেন। ভারতীয় খাবার ছাড়াও ইউরোপীয় এবং চীনা খাবারও সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়।
রাত্রিযাপন
[সম্পাদনা]কোণার্কে ভালো মানের থাকার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কম, তবে সময়ের সাথে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পুরী ও ভুবনেশ্বরের মতো জনপ্রিয় পর্যটনস্থলে হোটেল ও লজের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে কোণার্কেও বেশ কয়েকটি ভালো মানের থাকার জায়গা আছে।
- বনিতা লজ, কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮-২৩৬৪৯১। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা।
ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ - ৩০০ টাকা (শুধমাত্র থাকার জন্য)। - কোণার্ক লজ, কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮-২৩৬৫০২। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা।
ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ টাকা (শুধমাত্র থাকার জন্য)। - 1 লাবণ্য লজ, কোণার্ক ("শহর" থেকে বেরিয়ে সমুদ্র সৈকতের দিকে প্রধান রাস্তা ধরে এগিয়ে যান; ৫ মিনিটের হাঁটা পথ), ☏ +৯১ ৬৭৫৮-২৩৬৮২৪, ইমেইল: labanya@eodisha.com। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: দুপুর। পরিবারসহ ভ্রমণকারী ব্যাক্তি এবং একক অভিযাত্রী উভয়ের জন্যই উপযুক্ত। এখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাথরুমসহ এবং বাথরুম বিহীন কক্ষ রয়েছে(সবচেয়ে সস্তা)। এই লজটি কোণার্ক সূর্য মন্দির থেকে খুবই অল্প দূরত্বে অবস্থিত, তবে চন্দ্রভাগা সমুদ্রতট থেকে লজের অবস্থান অনেকটা দূরে। রিসেপশন এবং সংলগ্ন বারান্দার কাছাকাছি এলাকায় দুর্বল ওয়াই-ফাই সিগনাল পাওয়া যায়। সব বাথরুমেই মশার উপদ্রব রয়েছে, তাই বাথরুম ছাড়া কক্ষ নেওয়াই ভালো। হোটেলের পরিষেবা সাধারণ মানের—না ভালো, না খারাপ। এত ছোট শহরে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
ভারতীয় মুদ্রায় ২০০ - ৭৫০ টাকা (২০১৫ সালের প্রথম দিকে)। - রয়েল লজ, কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮-২৩৬৮১৮। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা।
ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫ - ১৫০ টাকা (শুধু থাকার জন্য)। - সান ভিলা কোণার্ক, কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮-২৩৬৮২১। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা।
ভারতীয় মুদ্রায় ২০০ - ২৫০ টাকা। - তারিণী লজ, কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮ -২৩৬৮৫৭। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা।
ভারতীয় মুদ্রায় ১৫০ - ৩০০ টাকা (শুধুমাত্র থাকার ব্যবস্থা)।। - 2 যাত্রিনিবাস, পি.ও.-কোণার্ক, ☏ +৯১ ৬৭৫৮ ২৩৬৮২০। আগমন: দুপুর, প্রস্থান: সকাল ১১ টা। শুধুমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ।
ভারতীয় মুদ্রায় ১৭৫০ - ৩৬০০ টাকা।
সম্মান
[সম্পাদনা]মন্দিরে প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের মাথা ঢেকে রাখতে হয় এবং নির্দিষ্ট স্থানে জুতো রেখে যেতে হয়। বিনামূল্যে ফটো তোলা যায়, তবে ভিডিও করতে চাইলে অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয়। স্থানীয় গাইড বা প্রদর্শক উপলব্ধ রয়েছে। তবে পর্যটকরা যদি চান, তাহলে বিস্তারিত তথ্যের জন্য কোণার্কের পর্যটন কর্মকর্তার সহায়তা নিতে পারেন।
স্থানীয় গাইডরা পরামর্শ দেন, যেহেতু সূর্য মন্দিরে এখন আর কোনো দেবতা প্রতিষ্ঠিত নেই, তাই দর্শনার্থীদের জুতো খুলে রাখা বা মাথা ঢাকার প্রয়োজন নেই।
কাছাকাছি জায়গা
[সম্পাদনা]- 3 কাকতপুর মঙ্গলা মন্দির (সূর্য মন্দির থেকে ৩০ কিমি দূরে))। পুরী-অস্তরঙ্গ সড়কে প্রাচী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ছোট মন্দির। এই মন্দিরটি দেবী মঙ্গলার জন্য বিখ্যাত। পুরীর নবকলেবর (দেবতাদের সংস্কার) উৎসবের সময় কাকতপুর মঙ্গলা মন্দিরের সাথে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। দেবী মঙ্গলার সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব হল 'ঝামু যাত্রা', যা প্রতি বছর পবিত্র বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল থেকে ১৫ মে) অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী গন্তব্য
[সম্পাদনা]- ভুবনেশ্বর -কোণার্ক থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর, যার ইতিহাস প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো। এই শহর তার মন্দিরসমূহ, একশিলা যুগের বৌদ্ধ গুহা এবং এশিয়ার বৃহত্তম চিড়িয়াখানার জন্য বিখ্যাত।
- চিলিকা - কোণার্ক থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লবণাক্ত জলের এই উপহ্রদটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ী পাখিদের সবচেয়ে বড় শীতকালীন আবাসস্থল। এই হ্রদটি বহু বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতির আবাসস্থল হিসেবেও পরিচিত।
- কটক - ৬৮ কিমি দূরে অবস্থিত একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং এখানে অনেক প্রাচীন মন্দির এবং খনন স্থান রয়েছে।
- গোপালপুর-অন-সি - কোণার্ক থেকে ১৮০ কিমি দূরে অবস্থিত একটি অত্যন্ত শান্ত এবং নির্মল সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র ভ্রমণকারীদের কাছে এটি একটি প্রিয় স্থান।
- পারাদ্বীপ - কোণার্ক থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর এবং সমুদ্রবন্দর, যেখানকার মানবসৃষ্ট উপহ্রদে সমুদ্রগামী জাহাজ অবতরণ করে।
- পুরী - কোণার্ক থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত দেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীনতম শহর এবং ধর্মীয় কেন্দ্র যেখানে জগন্নাথ মন্দিরের অবস্থান। নবদম্পতি এবং অবসরপ্রাপ্ত ভ্রমণার্থীদের কাছে এখানকার গর্জনশীল সমুদ্র সৈকতের নিবিড় আকর্ষণ রয়েছে।
- রাউরকেলা - কোণার্ক থেকে ২৮৫ কিমি দূরে অবস্থিত পাহাড়ের সারি এবং নদী দ্বারা বেষ্টিত একটি শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা।
{{#assessment:শহর|ব্যবহারযোগ্য}}
