ব্যবহারকারী:মোঃ রবিউল হাসান চৌধুরী

উইকিভ্রমণ থেকে

একজন বিএসসি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশোনা শেষ করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করছেন খাঁটি মধু, ঘি, কালোজিরার তেল। সেই সঙ্গে তার বিক্রির তালিকায় আরো আছে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, মুক্তাগাছার মন্ডা।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের সব খাবারকে ভেজালমুক্ত এবং সমাজ থেকে বেকারত্ব দূর করার। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পড়াশোনা শেষ করেই নিজ উদ্যোগেই শুরু করেন ‘সহজসরল ডটকম’ নামে এই মিষ্টি ও মধু বিক্রির ব্যবসা। নিজে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনে অর্ডার করার মাধ্যমে তিনি এসব খাবার ক্রেতাদের কাছে সরবাহ করে থাকেন।

ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকের সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও পথচারীদের কাছে শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। তারপরেও দমে যাননি তিনি। অদম্য ইচ্ছে শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজ স্বপ্ন পূরণের পথে। তার নাম রবিউল ইসলাম চৌধুরী। বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর এলাকায়। দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। বাবা খোরশেদ আলম চৌধুরী একজন কৃষক আর মা জাহানারা বেগম গৃহিণী। সম্প্রতি রাইজিংবিডির প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার।

কথায় কথায় জানালেন, তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কুমিল্লাতেই। ৯ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার ইচ্ছে জাগে দেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার। তার ভাষ্য, ‘আমার বড় ভাই সৌদি প্রবাসী ও আমাদের কুমিল্লার বেশির ভাগ মানুষই দেশের বাইরে কাজের জন্য যায়। সেখানে গিয়ে শ্রমিকের কাজই তারা করে থাকেন। বিদেশে গিয়ে যে কাজ করে তারা, সেই কাজ নিজ দেশে করতে তারা লজ্জা পান। ৯ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নিই, আমি দেশে থেকেই কাজ করবো। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবো।’


এরপর কুমিল্লাতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ঢাকায় আসার পর যে খাবারই কিনে খাচ্ছিলেন তিনি, কোনো কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছিলেন না। ভেজাল খাবারে ভরপুর ঢাকা শহরের কোনো খাবার খেয়ে তিনি তৃপ্তি পাননি। এরই মাঝে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিষয়ে অনার্স শেষ করেন। পড়াশোনা শেষ করে দেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে সিদ্ধান্ত নেন চাকরির পিছনে না ঘুরে তিনি ব্যবসা করবেন। ব্যবসা করার সব পরিকল্পনা থাকলেও তার কাছে ব্যবসা করার মতো কোনো টাকা ছিল না। তখন এক আত্মীয়ের কাছে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। ঋণ করা টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনেন একটি ফ্রিজ। ভালো ব্যবসা করার মতো তেমন কোনো টাকা না থাকায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে নিজ উদ্যোগে সহজসরল ডটকম নামে মিষ্টি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে কুমিল্লার রসমালাই ও টাঙ্গাইলের চমচম কিনে এনে রাস্তায় রাস্তায় তিনি বিক্রি করা শুরু করেন।

রবিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘লেখাপড়া করার কি দরকার ছিল যদি রাস্তায় মিষ্টিই বিক্রি করবি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নাকি আমি চাকরীতে নিরুৎসাহ করছি। এমনই নানা কথা শুনতে হয়েছে যখন আমি রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিক্রি শুরু করি। প্রথম ৬ মাস কেউই পাশে ছিল না। অনেকটা একা একা কাজ করতে হয়েছে। চারদিক থেকে শুধু কুটুক্তিই ছিল।’

তিনি বলেন, ‘৬ মাস পর ব্যবসায় তেমন লাভের মুখ না দেখলে মিষ্টি বিক্রি বন্ধ রেখে শুরু করি কাপড় বিক্রির ব্যবসা। রাস্তায় রাস্তায় ১০০ টাকা দামের টি-শার্ট বিক্রি করেছি এক মাস। কাপড় ব্যবসাতে ভালোই লাভ হয়। কাপড় বিক্রিতে বেশি লাভ হলেও আমার মন বসেনি। এরপর আবার আমার ভেজালমুক্ত খাবার সরবাহ করার ব্যবসায় ফিরে আসি। এবার বিভিন্ন মানুষ সাড়া দেয়। অনলাইনেও ভালোই অর্ডার পেতে শুরু করি। নির্ভেজাল খাবার সরবরাহ করার সংগ্রাম আবার শুরু হয়।’


রবিউল বলেন, ‘আমার পর্যাপ্ত টাকা ছিল না তাই আমি নিজেই মার্কেটিং এর জন্য রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি, মধু, কালজিরার তেল বিক্রি করার কাজ করেছি। শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ধানমন্ডি ১৫, সোবহানবাগ, কারওয়ান বাজার, খামার বাড়ি, পান্থপথ, গ্রীনরোড, মতিঝিল সহ শহরের অনেক ব্যস্ততম পয়েন্টে সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। অনবরত রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলাম। একটা টেবিল, ২/১ প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে। ২০ টাকা পিছ চমচম বিক্রি করেছি। সেই সঙ্গে লিফলেট/ভিজিটিং কার্ড দিয়েছি। যাতে পরবর্তীতে অর্ডার করে ক্রেতারা।’

‘আমি স্বপ্ন দেখি একদিন সহজসরল ডটকম অনেক বড় ব্র্যান্ড হবে। আমার কোম্পানিতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমার কাজের মাধ্যমে তরুণদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি যেন বেকার না থেকে কিছু একটা করে।’


বর্তমানে কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দই, মেহেরপুরের রস কদম, মুক্তাগাছার মন্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, খাঁটি ঘি, মধু ও কালোজিয়ার তেল সরবাহ করে আসছেন তিনি। অনলাইনে অর্ডার করা যায় এসব খাবার। এসব খাবার বিক্রি করে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান রবিউল।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকাসহ সব জেলাতে নূন্যতম একটি হলেও শাখা করব। যেখান থেকে নির্ভেজাল খাবার সরবরাহ করবো ক্রেতাদের কাছে। দুধ, বিশুদ্ধ পানি, মৌসুমি ফল, ফরমালিনমুক্ত সবজি, ফরমালিন মুক্ত মাছ, মিষ্টি, মধু, কালজিরার তেল, ঘি সহ সকল খাবার নিয়ে কাজ করব। আর সেই সঙ্গে সারাদেশে আমি একটি সেচ্ছাসেবী টিম গড়ে তুলতে চাই। যারা বেকারত্ব থেকে উঠে আসতে তরুণদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে।’

‘বর্তমানে আমি খাবার সরবাহ করার পাশাপাশি বেকার তরুণদের নানাভাবে ব্যবসায়িক পরামর্শ ফেসবুকে ও মোবাইল ফোনে কথা বলার মধ্যে দিয়ে আসছি। বাংলাদেশে একদিন কোনো মানুষই বেকার থাকবে না। কোনো না কোনো কাজে সবাই যুক্ত থাকবে।’ বাংলাদেশ একদিন ‘নির্ভেজাল খাদ্য ও বেকারমুক্ত’ দেশে পরিণত হবে এমনটাই আশা রবিউলের। ফেসবুক: www.facebook.com/sohojsorolbd, ওয়েবসইট: www.sohojsorol.com।