অস্ট্রিয়া পশ্চিম ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। স্থলবেষ্টিত এই দেশের উত্তরে জার্মানি ও চেক প্রজাতন্ত্র, পূর্বে স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণে স্লোভেনিয়া ও ইতালি, এবং পশ্চিমে সুইজারল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইন। অস্ট্রিয়া মূলত আল্পস পর্বতমালার উপরে অবস্থিত। দেশটির তিন-চতুর্থাংশ এলাকাই পর্বতময়।
শহর
[সম্পাদনা]অস্ট্রিয়ার পাঁচটি প্রধান শহর হল ভিয়েনা, গ্রাৎস, লিন্ৎস, জাল্ৎসবুর্গ এবং ইন্সব্রুক।
ভিয়েনা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি অস্ট্রিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। শহরটি দানিউব নদীর দুই তীরে অবস্থিত। এর শহরতলীগুলি পশ্চিমে বিখ্যাত ভিয়েনা অরণ্য পর্যন্ত চলে গেছে। ভিয়েনা ইউরোপের সবচেয়ে রাজকীয় শহরগুলির একটি। এখানে অনেক জমকালো বাসভবন, রাজপ্রাসাদ, পার্ক ও গির্জা আছে। শহরের জনসংখ্যা ১৬ লক্ষের বেশি।
গ্রাৎস অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি ষ্টাইয়ারমার্ক প্রদেশের রাজধানী। শহরটি একটি উর্বত উপত্যকায় মুর নদীর তীরে অবস্থিত। গ্রাৎস একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, বাণিজ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের বাস।
লিন্ৎস ওবারঅস্টাররাইখ প্রদেশের রাজধানী। এটি দানিউব নদীর তীরে অবস্থিত বন্দর শহর ও শিল্পকেন্দ্র।
জাল্ৎসবুর্গ অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে নয়নাভিরাম শহরগুলির একটি। এটি জাল্ৎসাখ নদীর তীরে আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। শহরটি বিখ্যাত সুরকার ভোলফগাং আমাদেউস মোৎসার্টের জন্মস্থান। এখানকার বাৎসরিক সঙ্গীত উৎসবগুলি সারা বিশ্বে পরিচিত। এখানে অনেক পর্যটক বেড়াতে আসেন।
ইন্সব্রুক টিরোলিয়ান আল্পস পর্বতমালায় সমুদ্র সমতল থেকে বহু উঁচুতে অবস্থিত একটি শীতকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র। এটি টিরোল প্রদেশের রাজধানী ও ইন নদীর তীরে অবস্থিত। ইন্সব্রুকের অবস্থান ও সৌন্দর্যের কারণে এখানেও অনেক পর্যটক বেড়াতে আসেন।
বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]ভূগোল
[সম্পাদনা]অস্ট্রিয়াকে তিনটি অসম ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে বৃহত্তম অংশটি (৬২%) হল আল্পস পর্বতমালার অপেক্ষাকৃত নবীন পাহাড়গুলি। এদের পূর্বে আছে পানোনীয় সমভূমি, এবং দানিউব নদীর উত্তরে আছে বোহেমীয় অরণ্য নামের একটি পুরানো কিন্তু অপেক্ষাকৃত নীচু গ্রানাইট পাথরে নির্মিত পার্বত্য অঞ্চল।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]অস্ট্রিয়ার ইতিহাস ৯৭৬ সালে শুরু হয়। ঐ বছর লেওপোল্ড ফন বাবেনবের্গ বর্তমান অস্ট্রীয় এলাকার বেশির ভাগ অংশের শাসকে পরিণত হন। ১২৭৬ সালে রাজা প্রথম রুডলফ হাব্স্বুর্গ বংশের প্রথম রাজা হিসেবে অস্ট্রিয়ার শাসক হন।
হাব্স্বুর্গ রাজবংশের রাজারা প্রায় ৭৫০ বছর অস্ট্রিয়া শাসন করেন। রাজনৈতিক বিবাহ সম্পাদনের মাধ্যমে হাব্স্বুর্গেরা মধ্য ইউরোপের এক বিরাট এলাকা দখলে সক্ষম হন। তাদের ভূসম্পত্তি এমনকি আইবেরীয় উপদ্বীপ (বর্তমান স্পেন) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৬শ ও ১৭শ শতকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের আক্রমণের ফলে অস্ট্রীয় এলাকাটি ধীরে ধীরে দানিউব নদীর অববাহিকার কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় অংশটিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৮৪৮ সালে প্রথম ফ্রান্ৎস ইয়োজেফ সিংহাসনে আরোহণ করেনে এবং ১৯১৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর আমলে অস্ট্রীয় ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। ১৮৬৭ সালে অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের ভেতরে হাঙ্গেরি আগের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পায়, ফলে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় দ্বৈত রাজ্যব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে। ২০শ শতকে এসে রাজনৈতিক টানাপোড়েন বৃদ্ধি পায় এবং ১ম বিশযুদ্ধ শেষে সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ঐ সময় অস্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যার সীমানা ও বর্তমান অস্ট্রিয়ার সীমানা মোটামুটি একই রকম। ১৯১৯ সালে সাঁ জেরমাঁ-র চুক্তির ফলে হাব্স্বুর্গ রাজবংশ সরকারিভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং অস্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯১৮ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়াতে রাজনৈতিক সংঘাত বৃদ্ধি পায়। ১৯২০-এর দশকের শেষে এবং ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে আধা-সামরিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলি হরতাল ও সহিংস সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বেকারত্বের হার বেড়ে ২৫% হয়ে যায়। ১৯৩৪ সালে একটি কর্পোরেশনবাদী স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রীয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক (নাৎসি) দল কু-এর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির সামরিক আগ্রাসনের হুমকির মুখে অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কুর্ট শুশনিগ অস্ট্রীয় নাৎসিদের সরকারে নিতে বাধ্য হন। ১৯৩৮ সালের ১২ই মার্চ জার্মানি অস্ট্রিয়াতে সৈন্য পাঠায় এবং দেশটিকে জার্মানির অংশভুক্ত করে নেয়। এই ঘটনাটির ঐতিহাসিক নাম দেয়া হয়েছে আন্শ্লুস (জার্মান ভাষায় Anschluss)। সেসময় বেশির ভাগ অস্ট্রীয় এই আনশ্লুস সমর্থন করেছিল।
১৯৩৮ সালের মার্চ থেকে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে অস্ট্রিয়ার অধিকাংশ ইহুদীকে হয় হত্যা করা হয় অথবা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়। সিন্তি, জিপসি, সমকামী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বীদেরও একই পরিণাম ঘটে। ১৯৩৮ সালের আগে অস্ট্রিয়াতে ২ লক্ষ ইহুদী বাস করত। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে এদের অর্ধেকের বেশি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। জার্মানরা ইহুদীদের ব্যবসা ও দোকানপাটে লুটতরাজ চালায়। প্রায় ৩৫ হাজার ইহুদীকে পূর্ব ইউরোপে গেটো বা বস্তিতে পাঠানো হয়। প্রায় ৬৭ হাজার ইহুদীকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়; যুদ্ধশেষে এদের মাত্র ২ হাজার বেঁচে ছিল।
১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের পর মিত্রশক্তিরা অস্ট্রিয়াকে চারভাগে ভাগ করে। ১৯৫৫ সালের ২৫শে অক্টোবর নাগাদ এরা সবাই অস্ট্রিয়া ত্যাগ করে এবং অস্ট্রিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা পায়।
ভাষা
[সম্পাদনা]অস্ট্রিয়াতে মূলত জার্মান ভাষার একটি পরিবর্তিত রূপ ব্যবহৃত হয়। এর নাম অস্ট্রীয় জার্মান। জার্মান ভাষায় এর নাম Schönbrunner Deutsch (শ্যোনব্রুনার ডয়চ অর্থাৎ রাজকীয় প্রাসাদের জার্মান)। অস্ট্রীয় জার্মান বর্তমান আদর্শ জার্মান ভাষা থেকে বেশ কিছু দিকে থেকে আলাদা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে সমস্ত স্বরধ্বনি আদর্শ জার্মান ভাষায় উচ্চারিত হয়, অস্ট্রীয় জার্মান ভাষায় সেগুলি উচ্চারিত হয় না; কিংবা সামান্য ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। অস্ট্রীয় জার্মান ভাষায় নিজস্ব প্রত্যয়েরও (suffix) ব্যবহার আছে। এছাড়া বলা হয়ে থাকে যে অস্ট্রীয় জার্মান খানিকটা নাসিক্য স্বরে (nasalized) বলা হয়ে থাকে।
অস্ট্রীয় জার্মান ভাষার উপভাষাগুলিকে আলেমানীয় উপভাষা ও দক্ষিণ বাভারীয় উপভাষা - এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আলেমানীয় উপভাষা দেশটির পূর্ব এক-তৃতীয়াংশে প্রচলিত (ফোরার্লবের্গ প্রদেশে)। আর দক্ষিণ বাভারীয় উপভাষাগুলি দেশের বাকি অংশে ব্যবহৃত। আলেমানীয় উপভাষাগুলি সুইজারল্যান্ডের জার্মান ও দক্ষিণ-পূর্ব জার্মানির ভাষাগুলির সাথে তুলনীয়। আর দক্ষিণ বাভারীয় উপভাষাগুলি জার্মানির বাভারিয়ার বা বায়ার্নের ভাষাগুলির সাথে তুলনীয়।
এছাড়াও অস্ট্রিয়ায় অনেকগুলি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজস্ব ভাষায় কথা বলে থাকে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল ক্রোয়েশীয়, স্লোভেনীয়, হাঙ্গেরীয়, চেক, স্লোভাক এবং জিপসি ভাষাসমূহ।