ভ্রমণপথ > এশিয়া ভ্রমণপথ > কারাকোরাম মহাসড়ক
কারাকোরাম মহাসড়ক (সংক্ষেপে: কেকে এইচ (kkh) অথবা কারাকোরাম) হল বিশ্বের উচ্চতম পাকা আন্তর্জাতিক সড়ক; যা পশ্চিম চীন এবং পাকিস্তানকে সংযুক্ত করেছে। সড়কটি হিমালয় অতিক্রমকারী অল্প কয়েকটি যাত্রাপথের মধ্যে অন্যতম এবং হিমালয় অতিক্রমকারী সড়কগুলির সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে এ সড়কটি পদযাত্রার জন্যে একটি লম্বা রাস্তা হিসেবে পরিচিত ছিলো যা প্রাচীন রেশম পথের একটি শাখা। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে চীন এবং পাকিস্তান সরকার সড়কটি নির্মাণ করে।
কারাকোরাম একটি মঙ্গোলীয় শব্দ, যার অর্থ হলো কালো নুড়ি এবং এই নামটি মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীরা মূলত কারাকোরাম গিরিপথকে বোঝাতে ব্যবহার করেছিল যখন সে অঞ্চলে মঙ্গোলদের বিশাল সাম্রাজ্য ছিল এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশধররা মুঘল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়ে, যারা বহু শতাব্দী ধরে ভারত শাসন করেছে। ফলে মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীরা ব্যবসার সূত্রে যখন সেই অঞ্চল থেকে ভারতে আগমন করত, তখন তারা হিমালয় হয়ে আসত এবং তারাই এই রাস্তাকে বুঝাতে কারাকোরাম শব্দ ব্যবহার করত।
সড়কটি বর্তমান একটি দুঃসাহসিক পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। দ্য গার্ডিয়ান এটিকে পাকিস্তানের তৃতীয় সেরা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করে। পাকিস্তান অংশের সীমান্তবর্তী খুঞ্জেরাব গিরিপথে এটি প্রায় ৪,৮০০ মিটার (প্রায় ১৬,০০০ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত, যা উচ্চতায় একে বিশ্বের উচ্চতম সীমান্ত ক্রসিং হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তুলনামূলকভাবে এ স্থানটি পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মন্ট ব্ল্যাঙ্ক (যার উচ্চতা ৪৮১০ মি.) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিন্দু মাউন্ট হুইটনি-এর মত (যার উচ্চতা হল ৪৪২১ মিটার)।
সাইকেল চালকদের জন্যে সড়কটি চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এই যাত্রাপথে সাইকেলে ভ্রমণ বিষয়ে বেশ কিছু বইও রয়েছে। তবে সন্ত্রাসী হামলার কারণে পাকিস্তানে ভ্রমণ ও সফরের সংখ্যা বর্তমান অনেক হ্রাস পেয়েছে। এই সড়কে একা স্বাধীনভাবেও ভ্রমণ করা সম্ভব। তবে তাপমাত্রা ও উচ্চতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত। কারণ এসব কারণে অনেকের পক্ষে ভ্রমণ অনেকাংশে অসম্ভব হতে পারে।
সাইকেল চালকদের জন্য সীমান্ত খোলা নেই। পরিবর্তে আপনি তাশকুর্গান (চীন) বা সোস্ট (পাকিস্তান) থেকে একটি বাসে উঠে ভ্রমণ করতে পারবেন। পাকিস্তানের দিক থেকে আপনি গিরিপথ পর্যন্ত সাইকেল চালিয়েও যেতে পারবেন; কিন্তু এর পর আর নয়! তখন পুনরায় বাস ধরতে সোস্টে ফিরতে হবে!
- আরও দেখুন: চীনে সাইকেলিং
অবস্থান
[সম্পাদনা]সড়কটি উত্তর-দক্ষিণে কারাকোরাম পর্বতমালা জুড়ে অবস্থিত এবং সীমান্তে খুঞ্জেরাব গিরিপথ দিয়ে চলে গেছে। পাকিস্তানে সড়কটি খাইবার পাখতুনখোয়া ও গিলগিত-বালতিস্তান প্রদেশের মধ্য দিয়ে অ্যাবোটাবাদ হয়ে পাকিস্তান–চীন সীমান্ত পর্যন্ত চলে যায়। সীমান্তের ওপারে এটি চীনের শিনচিয়াং প্রদেশের কিছু অংশ পেরিয়ে কাশগড় পর্যন্ত চলে গেছে। ১৯৭৯ সালে উভয় দেশের যৌথ প্রকল্প হিসেবে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৭৯ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯৮৬ সালে সড়কটি জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। সড়ক নির্মাণকালে প্রায় ৮০০ পাকিস্তানি এবং ২০০ জন চীনা শ্রমিক এতে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান। যাদের অধিকাংশই ভূমিধ্বস এবং পাহাড় থেকে নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
চীনে সড়কটি "মৈত্রী মহাসড়ক" নামে পরিচিত। এর অত্যাধিক উচ্চতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে তা নির্মিত হয়েছিল বলে এটিকে "বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য"ও বলা হয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]
ওয়াখান করিডোর ব্যাকট্রিয়া বা মধ্য আফগানিস্তানের মধ্যে বয়ে যাওয়া ওয়াখান করিডোর ঐতিহাসিকভাবে এটি একটি ক্ষুদ্র বাণিজ্য পথ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত যে, এটি আজকের কারাকোরাম সড়ক নয়; বরং উভয় আলাদা। কারণ এটি কঠিন ভূখণ্ডময় ও বিপজ্জনক ভৌগলিকের অধিকারী আফগানিস্তানে অবস্থিত এবং সেখানে ভালো কোনো রাস্তা বা সীমান্ত চৌকিও নেই। সেখান থেকে যে কেউ বৈধভাবে চীন বা পাকিস্তানে প্রবেশ করতে পারে না। |
প্রস্তুতি
[সম্পাদনা]কারাকোরাম মহাসড়ক হল পাকিস্তানের একটি দ্বিমুখী ও আবহাওয়াবান্ধব রাস্তা, যার খুঞ্জেরাব গিরিপথ ছাড়া বাকি অংশ ভারী তুষারপাতের কারণে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। বর্ষাকালে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) কিছু জায়গায় রাস্তার চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ রাখতে পারে এমন ভূমিধ্বস সেখানে অতি সাধারণ ঘটনা।
মহাসড়কের কিছু অংশ; যেমন পাকিস্তানের বেশাম ও চিলাসের মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং চীনা অংশের মরুভূমি অঞ্চলগুলি গ্রীষ্মকালে খুব গরম থাকে; যার তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সে. (১১৩ ফ.) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সবমিলিয়ে কারাকোরাম মহাসড়কে বসন্ত বা শরতের শুরুতে ভ্রমণ করা সবচেয়ে ভাল হবে।
আপনি সাইকেল, বাস, বাইক, কার যেকোন উপায়েই ভ্রমণ করতে পারেন; তবে সবচে' বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি হল মালবাহী গাড়িতে (ভ্যান) চড়ে যাওয়া, যা সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক। কেউ কেউ বলেন যে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাস্তাগুলির একটি; কারণ সড়কটির একদিকে অরক্ষিত রাস্তার প্রান্ত থেকে শত শত মিটার নিচে গর্তে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে; অন্যদিকে রয়েছে রাস্তার উভয়পাশে অস্থিতিশীল উঁচু পাহাড়, যা কঠোর আবহাওয়ার সময় ভূমিধ্বসের একটি বড় কারণ হতে পারে। কখনো কখনো রাস্তাটি কিছু জায়গায় এত সরু হয়ে গেছে যে, একইসময়ে কেবল একটি গাড়ি যেতে পারে; বিপরীতগামী গাড়িটি তখন রাস্তার খুবই সরু ও বিপজ্জনক প্রান্তে অপেক্ষায় থাকে। রাস্তায় আপনি প্রচুর ভাঙ্গা ও ভারি যান দেখতে পাবেন। বেশিরভাগ চলার পথ পাকিস্তানি অংশে অবস্থিত।
আপনি যদি সীমান্ত অতিক্রম করতে এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে চান; তবে আগেই থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের (চীন) ভিসা সংগ্রহ করে সাথে রাখতে হবে; অন্যথায় সীমান্তে প্রবেশ মঞ্জুর করা হবে না এবং যারা সাইকেলে সীমান্ত চৌকিতে পৌঁছে, তাদের প্রবেশও মঞ্জুর করা হয় না। তাই আপনাকে অবশ্যই একটি মোটর চালিত গাড়িতে করে যেতে হবে। তাই এই সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য নিকটবর্তী কোনো পাকিস্তানি শহর থেকে একটি বাসে উঠুন।
রাস্তার অবস্থা
[সম্পাদনা]১৩০০ কি.মি দীর্ঘ এ মহাসড়কটি প্রাকৃতিকভাবেই বহু জায়গায় যথেষ্ট পরিবর্তিত হতে থাকে এবং দূর্গম রাস্তা হওয়ায় তাড়াতাড়ি এটির সংস্কার করাও সম্ভব হয় না। হাসান আব্দাল থেকে রাস্তাটি ভালো অবস্থায় শুরু হয়; তবে যখনই এটি কোহিস্তান জেলায় উঠতে শুরু করে, তখন উল্লেখযোগ্যভাবে রাস্তার পিচের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। মোটামুটি বেশাম থেকে চিলাস পর্যন্ত এটি নদী ও উপত্যকার পাশ দিয়ে চলে গেছে; যেখানে নীচে রয়েছে সিন্ধু নদী এবং সংকীর্ণ ও এবড়োখেবড়ো রাস্তা। সেখানে বর্তমানও রাস্তায় নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে যানবাহন খুবই দ্রুতগতিতে চলাচল করে এবং দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আপনি যদি নিজে গাড়ি বা সাইকেল চালান; তবে এ বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। তবে রাস্তাটির এ অংশকে পুনর্নির্মাণ করার জন্য চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের আওতায় এখানে কাজ করা হচ্ছে। তাই আগামী বছরগুলিতে রাস্তার গুণমান এবং প্রস্থের উন্নতি হতে পারে।
চিলাসের পরে রাস্তার উপরিভাগ নাটকীয়ভাবে উন্নত হয় এবং চীন সীমান্ত পর্যন্ত বেশিরভাগ পথ মসৃণ এবং তা ডামার বা কংক্রিট দ্বারা নির্মিত।
চীনা অংশে মহাসড়কটি সাধারণত ভালো; যদিও ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাশকুরগানের পর থেকে উন্নয়ন কাজের জন্যে ঘন ঘন এবং বিরক্তিকরভাবে রাস্তা খনন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক ভূচিত্র চীনের দিকে মালভূমি; তাই পাকিস্তানি অংশে পাওয়া বেশিরভাগ বিপদজনক খাড়া বাঁধ এই অংশে পাওয়া যায় না।
প্রবেশ
[সম্পাদনা]এর পাকিস্তানি অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত হাসান আব্দাল শহর থেকে শুরু হয় এবং চীনা অংশ উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনচিয়াং প্রদেশের প্রধান শহর কাশগড় থেকে শুরু হয়। এ সড়কটি আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানে এন-৩৫ নামে এবং চীনে জাতীয় মহাসড়ক ৩১৪ বা জি৩১৩ নামে পরিচিত।
যদিও সড়কটি হাসান আব্দালে শুরু হয়েছে; তবে এর যাত্রার সাধারণ পয়েন্ট হল গিলগিত। আসলে আপনি যেকোন জায়গা থেকে এতে যাত্রা শুরু করতে পারেন। আপনি যদি গিলগিত থেকেই শুরু করতে চান, তাহলে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে গিলগিত পর্যন্ত একটি পিআইএ (পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থা) বিমানে আরোহণ করতে পারেন। এই বিমানযাত্রাটি আপনার কাছে খুবই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ হল, বিমানটি নাঙ্গা পর্বতের পাশাপাশি কে২ (যা পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ) এর চারপাশে উড়ে যাবে এবং আপনি পাকিস্তানের এমন ৮২টি চূড়া দেখতে পারেন, যেগুলোর কোনটির উচ্চতা প্রায় ৭,০০০ মিটারের বেশি।
যারা হাসান আব্দাল থেকে যাত্রা শুরু করতে ইচ্ছুক, তারা পাকিস্তানের দীর্ঘতম হাইওয়ে এন-৫ ধরুন যা দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর করাচি থেকে শুরু হয় এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পেশাওয়ার পর্যন্ত যায়— বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরুন; উভয়ই মাঝপথে হাসান আব্দালের সাথে মিলিত হয়। সড়কের নিকটবর্তী প্রধান শহর হল রাওয়ালপিন্ডি। তবে পেশোয়ার বা অ্যবোটাবাদের মত উত্তরাঞ্চলীয় শহর এবং মানসেহরার মত বড় শহরেও প্রচুর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলাচল, যাদের মাধ্যমে আপনি সহজে হাসান আব্দালে নামাতে পারবেন। তবে এতে ভাড়াখরচ অধিক পড়তে পারে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে শীতাতপ অনিয়ন্ত্রিত বাস ও মালবাহী গাড়ি এক ঘন্টারও কম বিরতিতে নিয়মিত ছেড়ে যায়। এসবের কোনোটি অত্যন্ত আরামদায়ক নাও হতে পারে। তবে রাওয়ালপিন্ডি থেকে সড়ক পর্যন্ত বাসে যেতে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। তাই ননএসি বা মালবাহী গাড়ি বেছে নেওয়া যেতে পারে।
যাওয়া
[সম্পাদনা]এখানে ভ্রমণসূচীটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে নির্দেশ করা হয়েছে। কারণ কারাকোরাম সড়কের বেশিরভাগ অংশই দক্ষিণে পড়ে।
হাসান আব্দাল
[সম্পাদনা]পাকিস্তানের ঐতিহাসিক শহর হাসান আব্দাল হলো সড়কটির সূচনাবিন্দু এবং পাঞ্জাব প্রদেশের একমাত্র শহর, যা কারাকোরাম মহাসড়কের সাথে যুক্ত রয়েছে। এখানেই দুইটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাস্তা; গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ও কারাকোরাম মহাসড়ক একে অপরের সাথে মিলিত হয়েছে।
এ শহরে রয়েছে গুরুদুয়ারা পাঞ্জা সাহেব যা শিখ ধর্মের একটি অন্যতম পবিত্র স্থান এবং এটি শিখদের জন্যে একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থানও। শিখরা সারা বিশ্ব থেকে বিশেষ করে বেসাখী মরসুমে এই শহরে আসেন।
তক্ষশীলা
[সম্পাদনা]হাসান আব্দাল থেকে ২০ কিমি পূর্বে তক্ষশীলা নামের মনোমুগ্ধকর একটি প্রাচীন জনপদ রয়েছে। জনপদটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং এটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের ঐতিহাসিক স্থান। তক্ষশিলা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে অবস্থিত এবং এটি দেখার মতো একটি জায়গাও। এতে প্রচুর আবাসন সুবিধা ও হরেক রকমের খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি হরিপুরের সাথে এটির সরাসরি সড়কের সংযোগ থাকার কারণে ভ্রমণকারীরা এতে একটি দুর্দান্ত যাত্রা উপভোগ করে।
হরিপুর
[সম্পাদনা]পশতুনদের আবাসভূমি খাইবার পাখতুনখোয়া হরিপুর থেকেই পাহাড়ি এলাকায় আরোহণ করতে করতে শুরু হয়। হরিপুর হাসান আব্দাল থেকে প্রায় ৩০ কি. মি. ও তক্ষশীলা থেকে ৪০ কি. মি. উত্তরে অবস্থিত। হাসান আব্দাল অথবা তক্ষশীলা উভয় স্থান থেকেই এই শহরে পৌঁছানো যায়; অধিকন্তু এ দুইটি সড়কের মধ্যে হাসান আব্দালগামী সড়কটি অধিক প্রশস্ত হওয়ার কারণে বেশিরভাগ বাস সেটিই ব্যবহার করে এবং এটি অধিক সুবিধাজনকও।
হাভেলিয়ান
[সম্পাদনা]হরিপুর থেকে প্রায় ২৫ কিমি উত্তরে হাভেলিয়ান অবস্থিত। এটি কারাকোরাম শুরুর স্থান। এখান থেকে কারাকোরাম মহাসড়কে উঠতে হয়। সড়ক সংযোগ ছাড়াও হাভেলিয়ান পাকিস্তানের একমাত্র অভ্যন্তরীণ স্থান, যেখানে ট্রেনও চলাচল করে। হাজারা এক্সপ্রেস নামে একটি শীতাতপ অনিয়ন্ত্রিত ট্রেন প্রতিদিন এতে চলাচল করে। ট্রেনটি করাচি থেকে যাত্রা শুরু করে পাঞ্জাবের বিভিন্ন বড় শহর হয়ে হাভেলিয়ান পৌঁছে।
অ্যাবোটাবাদ
[সম্পাদনা]অ্যাবোটাবাদ হলো উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের হাজারা অঞ্চলের একটি শহর। শহরটি ইসলামাবাদ–রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১২০ কিমি (৭৫ মাইল) উত্তরে এবং পেশোয়ার থেকে ১৫০ কি.মি. (৯৫ মাইল) পূর্বে অবস্থিত। শহরটি প্রায় ১২৫৬ মিটার (৪,১২১ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। কাশ্মীর এর পূর্বে অল্প দূরে অবস্থিত। এখানে ৫০ একর জায়গা জুড়ে একটি বিনোদন পার্ক রয়েছে; যেখানে একটি চিড়িয়াখানা, আধুনিক পর্যটন সুবিধাসহ রেস্টুরেন্ট ও কৃত্রিম জলপ্রপাত রয়েছে। বিনোদন পার্কটি একটি দর্শনযোগ্য স্থান।
মানসেহরা
[সম্পাদনা]মানসেহরা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার পূর্বে অবস্থিত মনসেহরা জেলার একটি শহর। মনসেহরা খাইবার পাখতুনখোয়ার বৃহত্তম শহরগুলির অন্যতম একটি জাকমকপূর্ণ শহর।
কাগান উপত্যকা (বিকল্প)
[সম্পাদনা]কাগান উপত্যকা থেকে কারাকোরাম মহাসড়কে উঠার বিকল্প রাস্তা হল: বালাকোট > কাওয়াই - শোগরান > পারস - শরণ > খানিয়ান - কাগান > নারান > বাবুসার পাস > কারাকোরাম
তবে কাগান উপত্যকার এই বিকল্প পথটি প্রায়শ ভারী তুষারপাতের কারণে অবরুদ্ধ থাকে। তাই আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এতে ভ্রমণ করা উচিত।
বাটগ্রাম
[সম্পাদনা]বাটগ্রাম হল খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাটগ্রাম জেলার একটি শহর ও ইউনিয়ন পরিষদ । এটি ১০৩৮ মিটার (৩৪০৮ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত।
বেশাম
[সম্পাদনা]বেশম খাইবার পাখতুনখোয়ার শাংলা জেলার একটি শহর। শহরটি সিন্ধু নদীর ডান তীরে অবস্থিত। বেশাম কারাকোরাম সড়কের একটি প্রধান জংশন হিসাবে কাজ করে। পর্যটকরা যদি হুনজা ভ্যালি ও গিলগিটের উদ্দেশ্যে কারাকোরাম সড়কে ওঠে; তবে বেশামের মধ্য দিয়ে যায়। কারণ হল, কাগান উপত্যকার বিকল্প পথটি প্রায়শ ভারী তুষারপাতের কারণে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। এতে সিন্ধু নদীর তীরে একটি মনোরম ও আরামদায়ক বিশ্রামাগার, যা পাকিস্তান পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত হয়।
চিলাস
[সম্পাদনা]চিলাস হল পাকিস্তানের কাশ্মীরের একটি শহর এবং এটিও সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত।
এটি মহাসড়কের একটি প্রধান শহর, যা প্রাচীন রেশম পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজ ছিল এবং বর্তমানে শহরটি গিলগিত-বালতিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে কাজ করে। এটি পর্যটকদের সরবরাহ মজুদ করা এবং কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্যেও একটি ভালো জায়গা হতে পারে। এতে একটি বিমানবন্দরও রয়েছে এবং এই শহর থেকে গিলগিট-বালতিস্তানের আশেপাশের অধিকাংশ জায়গার পাশাপাশি রাজধানী ইসলামাবাদ ও কাশগড়ের মত দূরবর্তী শহরের বাসও নিয়মিত চলাচল করে।
নগরখাস
[সম্পাদনা]নগরখাস গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলের একটি শহর এবং এটি নাগর নদীর তীরে অবস্থিত। শহরটি অনেক পর্বতশৃঙ্গের আবাসস্থল; যার মধ্যে রয়েছে রাকাপোশি (৭,৭৮৮ মিটার) ও দিরান।
আলিয়াবাদ
[সম্পাদনা]আলিয়াবাদ গিলগিত-বালতিস্তানের হুনজা জেলার প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
এটি হুনজার রাজধানী; এতে অনেক আবাসনব্যবস্থা এবং বালতিট দুর্গের ইউনেস্কো স্বীকৃত ঐতিহাসিক স্থানসমূহ রয়েছে।
এটি উচ্চতর হুনজার প্রাচীন রাজধানী (গোযাল) এবং কারাকোরামের একটি মোটামুটি ছোট শহর। পুরানো শহরে কিছু ঐতিহাসিক ভবন দেখা যায় এবং বড় বড় পাহাড়ের নিম্নভূমি দেখতে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ( বিশেষ করে তুপোপদানের দৃশ্য )। গুলমিত ও গলকিনে বেশ কয়েকটি ভ্রমণযোগ্য ও আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। তবে এখানে হিমবাহের তীব্রতা রয়েছে। তাই ভ্রমণকারীদের আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা উচিত।
২০১০ সালে একটি ভূমিধ্বসের ফলে লেকটি সৃষ্টি হয়। ২১ কিলোমিটারের এ হ্রদটি ৫ বছর ধরে কারাকোরাম সড়কের একটি অংশকে নিমজ্জিত করে রেখেছিল। এখন সেই প্লাবিত উপত্যকার তলদেশ ঘেঁষে একাধিক নিরাপদ ও শক্তিশালী টানেল তৈরি করা হয়েছে। এতে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত; কারণ রাস্তাটি মজবুত হলেও এর টানেলগুলি কখনো কখনো আলোহীন থাকে। এটি ৩.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ; তাই সাইকেল চালকদের বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া উচিত। হ্রদটির নিজস্ব একটি আকর্ষণীয় ফিরোজা রঙ রয়েছে এবং এর উত্তর তীরে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
পাসু হল বিশাল হিমবাহের পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম। আইকনিক মাউন্ট তুপোপদানের সেরা দৃশ্যের সাথে সাথে পাসু অবশ্যই দেখার মত। বিখ্যাত গ্লেসিয়ার ব্রীজ ক্যাফে এবং পাসু ঝুলন্ত সেতুও বেশ আকর্ষণযোগ্য।
সোস্ট কারাকোরাম সড়কের পাকিস্তানি প্রান্তের শেষ শহর। এখানে আপনাকে পাকিস্তান হতে প্রস্থান করার অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে এবং চীনগামী গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে কোন মোটরচালিত বাহনে উঠা ব্যতীত আপনি সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবেন না। তাই এখানে অবশ্যই চীনগামী কোনো বাস ধরতে হবে।
এখানে পাকিস্তান–চীন সীমান্ত ৪৬৯৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। খুঞ্জেরাব জাতীয় উদ্যান ও সোস্টের মধ্যবর্তী কারাকেরাম সড়কের চারপাশের দৃশ্যাবলী একজন ভ্রমণকারীর কাছে অবিশ্বাস্যভাবে নাটকীয় মনে হতে পারে। যদিও এ পাসটি কিছুটা অস্বস্তিকর হতে পারে। আপনি যদি পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে আসেন, তবে এখান থেকে কোন মতেই সীমান্ত অতিক্রম করা সম্ভব নয়; আপনাকে অবশ্যই সোস্টে ফিরে যেতে হবে এবং সীমান্তগামী একটি বাস ধরতে হবে।
তাশকুরগান
[সম্পাদনা]তাশকুর্গান চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সুদূর পশ্চিমে অবস্থিত একটি শহর এবং পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে সড়কের কাছে অবস্থিত এটিই প্রথম চীনা শহর। এর জনসংখ্যা বেশিরভাগ জাতিগতভাবে তাজিক। শহরটি পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত।
এই অঞ্চলটি সাধারণত পুরানো রেশম পথের প্রধান সড়ক হিসাবে পরিচিত যা চীন থেকে পশ্চিম এশিয়ায় যাওয়ার প্রধান পথ ছিল। অঞ্চলটির গড় উচ্চতা প্রায় ৪,০০০ মিটার।
কারাকোল হৃদ
[সম্পাদনা]কারাকোল লেক চীনের শিনচিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে প্রায় ২০০ কি.মি. দূরে কারাকোরাম মহাসড়কের কিজিলসু কিরগিজ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত।
নিরাপদ থাকুন
[সম্পাদনা]কারাকোরাম মহাসড়কটি পাকিস্তানের তুলনামূলক নিরাপদ অংশে অবস্থিত হলেও একে আপনি একটি আতিথ্যহীন ভূখণ্ড মনে করতে পারেন। তবে দক্ষিণ থেকে আপনি যত উত্তরে যাবেন, ততই নিরাপত্তা বোধ করবেন; বিশেষ করে গিলগিত ও বর্ডার পাসে। দক্ষিণ গিলগিতের অধিকাংশ জনসংখ্যাই ক্রমবর্ধমানভাবে পশতুন-অধ্যুষিত এবং তারা খাইবার পাখতুনখোয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পরিস্থিতি দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত। তাই আপনি যদি নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন তাহলে আপনি ইসলামাবাদ থেকে গিলগিত অথবা স্কার্দু পর্যন্ত সরাসরি বিমানে যাতায়াত করতে পারেন এবং বিমান থেকে কারাকোরাম সড়কের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
এছাড়াও সাধারণ অস্থিরতা, পুলিশ, সরকার বা স্থানীয় রাজনীতির প্রতি অসন্তোষ মাঝে মাঝে গিলগিতের নিম্নভূমিতে সমস্যা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলে। তাই ভ্রমণের আগে অন্য পর্যটকদের অনুসরণ করুন এবং তারা কেমন প্রতিক্রিয়া করে তা খেয়াল করুন। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অবলোকন এবং সাধারণ জ্ঞান সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে উপত্যকা ও এলাকাটি দৃশ্যত অত্যাশ্চর্য। এখানেও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের স্থানীয় মানুষ রয়েছেন, যারা ভ্রমণকারীদের সাহচর্যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে আগ্রহ প্রদর্শন করেন। করিমাবাদের কাছে একদল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য সর্বদা অবস্থান করে। উপত্যকার উপরের অংশে নিরাপত্তার স্বার্থে কেবল স্থানীয় পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে।
এখানে অধিক উচ্চতার কারণে বিভিন্ন মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৫০০ মিটারের উচ্চতায় অবস্থান করার ফলে অনেকেরই বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। কখনো এই উচ্চতা বেড়ে ৩,৫০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। তাই যদি আপনার দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে অথবা অস্বাভাবিক উচ্চতায় আপনি অসুস্থতা বোধ করতে পারেন, তাহলে নিজের সাথে একটি অক্সিজেন মাস্ক বহন করবেন।
ভ্রমণ অবস্থায় সর্বদা তুষারপাত এবং ভূমিধ্বস থেকে সাবধান থাকবেন। ভ্রমণে যাওয়ার কথা ভাবার আগেই স্থানীয় সংবাদ ও আবহাওয়াবিষয়ক প্রতিবেদনগুলি যাচাই করে দেখুন। বৃষ্টি বা প্রচণ্ড তুষারপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ভ্রমণ করা এড়িয়ে চলুন। শীতকালে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। সম্ভাব্য দুর্ঘটনার জন্য সাথে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা-কিট বহন করুন এবং বাহনের জন্য প্রস্তাবিত গতিসীমা মেনে চলুন, যা ঋতু বা আবহাওয়াভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। বাতাস খুব শক্তিশালী এবং হিমশীতল হতে পারে; তাই সাথে প্রচুর গরম পোশাক বহন করুন।
পাকিস্তানে বামে গাড়ি চালানো হয়; তবে চীনে ডানদিকে।