বিষয়বস্তুতে চলুন

উইকিভ্রমণ থেকে

মুঘল সাম্রাজ্য

মুঘল সাম্রাজ্য বা মোগল সাম্রাজ্য ১৫২০-এর দশক থেকে ১৭০০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ অংশ শাসন করেছিল। এরপর সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন শুরু হয়, যদিও এর অবশিষ্টাংশ ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

তাজমহল

মুঘলরা ছিলেন মহান স্থপতি; ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে অবস্থিত অনেক সুপরিচিত ও সর্বোৎকৃষ্ট স্থাপত্য নির্মিত হয়। তাদের শাসনামলে নির্মিত স্থাপত্যগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে তাজমহল

তারা সংস্কৃতির অন্যান্য অনেক দিকেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, মুঘলরাই ছিলেন এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম বিস্তারের প্রধান কারণ। তারা ছিলেন মুসলিম শাসক যারা প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল শাসন করতেন। তাদের শাসনকাল ধর্মীয় উত্তেজনা থেকে মুক্ত ছিল না, তবে সমসাময়িক খ্রিস্টান স্পেনীয় সাম্রাজ্যের তুলনায় তারা অন্যান্য ধর্মের প্রতি উল্লেখযোগ্যভাবে সহনশীল ছিল। যে সমস্ত দেশ একসময় এই সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, আজও সেখানে ইসলাম ধর্মের উপস্থিতি মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনের ফলস্বরূপ।

উৎপত্তি এবং উত্থান

[সম্পাদনা]
বিভিন্ন সময়ে সাম্রাজ্য

বাবরের হাতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি একজন ফারসি ভাষাভাষী মুসলিম, যার পূর্বপুরুষদের মধ্যে চেঙ্গিস খান ছিলেন; ‘মুঘল’ শব্দটি ‘মঙ্গোল’ থেকে উদ্ভূত। বাবরের পিতামহ ছিলেন তিমুর, যিনি পশ্চিমে তামারলেন নামে পরিচিত এবং তিনি মধ্য এশিয়ার আরেকজন বিশাল সাম্রাজ্যজয়ী ছিলেন। পশ্চিমা ইতিহাসে এই সময়কালকে সাধারণত মুঘল সাম্রাজ্য নামে অভিহিত করা হয় এবং এটি আধুনিক ভারতীয় বা পাকিস্তানি লেখায়ও বহুল ব্যবহৃত। তবে শাসকরা নিজেদের ‘তিমুরি বংশ’ বলেই পরিচয় দিতেন।

বাবরের পিতা সামরকন্দ সংলগ্ন ফারগানা উপত্যকা অঞ্চলে রেশম পথের ওপর শাসন করতেন। পরিবারটির এবং তাদের অধীনস্থদের মধ্যে মঙ্গোল ও তুর্কি উভয় ধরনের পূর্বপুরুষ ছিল, তবে সাংস্কৃতিকভাবে তারা ফারসি ছিল; তাদের মাতৃভূমি ছিল পুরোনো ফারসি সাম্রাজ্যর উত্তরের প্রান্তে। বাবর সেখানে থেকে একটি সেনাবাহিনী নিয়ে বাকত্রিয়া হয়ে, সালাং গিরিপথ পার করে আফগানিস্তান আসে, এরপর খাইবার গিরিপথ পার হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তিনি বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারতের উত্তরাংশের বেশিরভাগ এলাকা জয় করেন এবং রাজধানী স্থাপন করেন আগ্রায়

মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা সাধারণত ১৫২৬ সালের পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয়ের সময় থেকে ধরা হয়। মানচিত্রে হালকা কমলা রঙের রেখাটি ১৫৩০ সালে বাবরের মৃত্যুকালে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি নির্দেশ করে। তার উত্তরসূরিরা এটিকে আরও অনেক দূর প্রসারিত করেন, যা মানচিত্রের অন্যান্য রেখাগুলিতে দেখানো হয়েছে।

শিখর সময়

[সম্পাদনা]

মুঘলদের সোনালি যুগ প্রায় ১৫০ বছর ধরে বিস্তৃত ছিল এবং এটি চারজন সম্রাটের শাসনকালে গড়ে ওঠে। এই সময়কাল শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালে আকবরের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময়। এই সময়ে সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং শিল্প ও বিজ্ঞান ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বিশেষ করে, এ সময়ে অসংখ্য বিখ্যাত ভবন নির্মাণ করা হয়। মুঘল যুগে উৎকৃষ্ট মানের গালিচাও তৈরি করা হত।

ফতেহপুর সিক্রির অনুপ তালাও

আকবর ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেন এবং সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করে ভারতের উত্তরাঞ্চল, বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় সমগ্র অঞ্চল এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন, যা মানচিত্রে মাঝারি কমলা রঙের রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে। তিনি আগ্রার কাছে একটি নতুন রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণ করেন এবং কয়েক বছর সেখান থেকে শাসন করেন। পরে তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে এবং কিছু সময় পর আবার আগ্রায় ফিরিয়ে নেন। আজ ফতেহপুর সিক্রির পুরো রাজকীয় শহর এবং লাহোর কেল্লা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত, যা মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

জাহাঙ্গীর ১৬০৫ থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি পার্সিয়ানদের কাছে কান্দাহার হারান, কিন্তু উপমহাদেশের অভ্যন্তরে মুঘল সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করেন।

শাহজাহান ১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেন এবং তার শাসনকালে মুঘল শিল্প ও স্থাপত্য তার শিখরে পৌঁছে। তার শাসনামলে তাজমহলসহ দিল্লির বেশ কিছু অনন্য ভবন নির্মিত হয়।

আওরঙ্গজেব ছিলেন কঠোর প্রকৃতির ব্যক্তি, যিনি সিংহাসন দখল করে তার পিতা শাহজাহানকে বন্দী করেন। তিনি ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন এবং সাম্রাজ্যকে তার সর্বোচ্চ বিস্তৃতিতে নিয়ে যান, যা মানচিত্রে গাঢ় লাল রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে।

লাহোরের শালিমার বাগান

১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষে, মানচিত্রে গাঢ় লাল রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে, মুঘল সাম্রাজ্য তার সর্বাধিক বিস্তৃতিতে পৌঁছায়। এরপর থেকে সাম্রাজ্যের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে।

১৭৩৬ সালে পার্সিয়ান আক্রমণকারীরা মুঘল রাজধানী দিল্লি লুঠ করে। মারাঠা সাম্রাজ্যের হিন্দু শাসকরা মুঘলদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং ১৭৫০ সালের মধ্যে মারাঠারা উপমহাদেশের বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশরা বাংলা জয় করে এবং পরবর্তী একশো বছর ধরে মুঘল ও মারাঠাদের ক্ষমতা ক্ষয় করে নিজেদের এলাকা ও প্রভাব বিস্তার করে।

১৮০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়েও একজন মুঘল সম্রাট ছিলেন, তবে সাম্রাজ্য বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠার পরপরই মুঘল বংশের চূড়ান্ত পতন ঘটে। শেষ মুঘল সম্রাট ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিলেন, ফলে ব্রিটিশরা তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে, তার জমিদারি কেড়ে নেয় এবং তাকে বার্মায় নির্বাসিত করে। এরপরও হায়দ্রাবাদের নিজামের মতো মুঘল সম্পর্কিত কিছু মুসলিম শাসক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন।