বাহরাইন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। বাহরাইন পারস্য উপসাগরের পশ্চিম অংশের ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর পূর্বে সৌদী আরব ও পশ্চিমে কাতার। সবচেয়ে বড় দ্বীপটিও বাহরাইন নামে পরিচিত এবং এতে দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী মানামা অবস্থিত।
প্রায় ৫,০০০ বছর আগেও বাহরাইন একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। সবসময়ই এটি শক্তিশালী প্রতিবেশীদের অধীনস্থ ছিল। ১৭শ শতকে এটি ইরানের দখলে আসে। ১৭৮৩ সালে মধ্য সৌদী আরবের আল-খলিফা পরিবার নিজেদেরকে বাহরাইনের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তখন থেকে তারাই দেশটিকে শাসন করে আসছে। ১৯শ শতকের কিছু সন্ধিচুক্তির ফলে যুক্তরাজ্য দেশটির প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব পায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাহরাইন ব্রিটিশ প্রভাবাধীন ছিল।
বাহরাইনের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি সেখানেই জন্ম-নেওয়া। এছাড়া বাহরাইনে শিয়া মুসলিমদের সংখ্যা সুন্নী মুসলিমদের প্রায় দ্বিগুণ। তবে সুন্নীরা বাহরাইনের সরকার নিয়ন্ত্রণ করেন।
১৯৩০-এর দশকে বাহরাইন পারস্য উপসাগরের প্রথম দেশ হিসেবে তেল-ভিত্তিক অর্থনীতি গঠন করে, কিন্তু ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকেই এর সমস্ত তেল ফুরিয়ে যায়। তবে দেশটি এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আগেভাগেই অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ করে রেখেছিল এবং দেশটির অর্থনীতি এখনও উন্নতি করে যাচ্ছে।
শহর
[সম্পাদনা]- মানামা
- মুহাররাক
- বুদাইয়া
- রিফা
- আমওয়াজ
- জাল্লাক
- দিয়ার আল মুহাররাক
- ইসা টাউন
- হামাদ টাউন
ইত্যাদি ছোট ছোট অনেক শহর ও পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে।
পর্যটন
[সম্পাদনা]বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]ভূগোল
[সম্পাদনা]বাহরাইন রাষ্ট্রটি আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে ২৪ কিমি দূরে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ৩২টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপটির নাম বাহরাইন দ্বীপ। দ্বীপটির বেশির ভাগ অংশ মরুময় ঊষর নিম্নভূমি। কেবল উত্তরের উপকূলে এক চিলতে সমভূমি আছে যেখানে রাজধানী মানামা অবস্থিত।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]বর্তমান বাহরাইন অঞ্চলে ব্রোঞ্জ যুগে দিলমুন নামক সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। ৫ হাজার বছর আগেও বাহরাইন সিন্ধু অববাহিকা ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ অব্দের দিকে ভারত থেকে বাণিজ্য আসা বন্ধ হয়ে গেলে দিলমুন সভ্যতার পতন ঘটা শুরু করে। ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আসিরীয় রাজার বাহরাইনকে ক্রমাগত নিজেদের বলে দাবী করতে শুরু করে। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পরে দিলমুন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর অনেক দিন যাবৎ বাহরাইনের কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে পারস্য উপসাগরে মহাবীর আলেকজান্ডারের পদার্পণ ঘটলে আবার এর হদিস পাওয়া যায়। যদিও আরব গোত্র বনি ওয়াএল এবং পারসিক গভর্নরেরা অঞ্চলটি শাসন করতেন, খ্রিস্টীয় ৭ম শতক পর্যন্তও এটি গ্রিক নাম তিলোস (Tylos) নামে পরিচিত ছিল। ঐ শতকে এখানকার অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। বাহরাইন ছিল আঞ্চলিক বাণিজ্য ও মুক্তা আহরণ কেন্দ্র। ৭ম শতক থেকে বিভিন্ন পর্বে এলাকাটি সিরিয়ার উমাইয়া বংশীয় খলিফাগণ, বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাগণ, পারসিক, ওমানি এবং পর্তুগিজদের দ্বারা শাসিত হয়। শেষ পর্যন্ত বনি উতবাহ গোত্রের আল খালিফা পরিবার ১৭৮৩ সালে ইরানীদের কাছ থেকে অঞ্চলটি দখল করে এবং তখন থেকে আজ পর্যন্ত তারা বাহরাইনের শাসক। ১৮৩০-এর দশকে আল খালিফা পরিবার একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাহরাইনকে একটি ব্রিটিশ প্রটেক্টোরেটে পরিণত করে, অর্থাৎ যুক্তরাজ্য বহিরাক্রমণ থেকে দেশটির সুরক্ষার দায়িত্ব নেয় এবং এর বিনিময়ে বাহরাইন যুক্তরাজ্যের অনুমতি ছাড়া অন্য কোন বিদেশি শক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ হারায়। বাহরাইনে বড় আকারে খনিজ তেলের উৎপাদন শুরু হবার কিছু পরেই ১৯৩৫ সালে পারস্য উপসাগর অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটিটি বাহরাইনে নিয়ে আসা হয়। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকার পারস্য উপসাগরের শেখশাসিত রাজ্যগুলির সাথে ইতোমধ্যে করা চুক্তিগুলি রদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় বাহরাইন কাতার এবং বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৭টি শেখরাজ্যের সাথে মিলে একটি বৃহৎ সংযুক্ত আরব আমিরাত গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ এই নয় রাজ্য সংযুক্তিকরণের বিভিন্ন ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। ফলে ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট বাহরাইন একক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। নতুন রাষ্ট্র বাহরাইনের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয় এবং ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচিত হয়, কিন্তু মাত্র দুই বছর পরে ১৯৭৫ সালে বাহরাইনের আমির সংসদ ভেঙে দেন, কেননা নির্বাচিত সংসদ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আল-খলিফা শাসনের অবসান এবং মার্কিন নৌবাহিনীকে সেখান থেকে বিতাড়নের প্রচেষ্টা করছিল। ১৯৯০-এর দশকে বাহরাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া সম্প্রদায়ের অসন্তুষ্টি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতের আকারে প্রকাশ পায়। এর প্রেক্ষিতে বাহরাইনের আমির প্রায় ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত, ১৯৯৫ সালে, বাহরাইনের মন্ত্রীসভায় পরিবর্তন আনেন, এবং আইন পর্যালোচনাকারী কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ৩০ থেকে ৪০-এ বৃদ্ধি করেন। এর ফলে সংঘাতের পরিমাণ প্রথমে কিছু কমলেও ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে বেশ কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁ-তে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে এবং এতে অনেকে নিহত হয়। পুলিশ প্রায় ১ হাজার লোককে এর জের ধরে গ্রেফতার করে এবং কোন বিচার ছাড়াই এদের শাস্তি দেয়া হয়। সম্প্রতি বাহরাইন সরকার এদের অনেককে ছেড়ে দিয়েছে। বাহরাইন ১৯৭১ সালে স্বধীনতা লাভ করে। বাহার শব্দের অর্থ সাগর আর বাহরাইন হচ্ছে দু'টি সাগর। এটি একটি দ্বীপ রাষ্ট্র এর চারদিকে সাগর।
ভাষা
[সম্পাদনা]আরবি ভাষা বাহরাইনের সরকারি ভাষা। এছাড়াও এখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিতে ফার্সি ভাষা, উর্দু ভাষা, এবং হিন্দি ভাষা বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য এবং পর্যটন শিল্পে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাহরাইনে সাত লক্ষের কিছু বেশি লোকের বাস। এদের ৯৯% মুসলমান। বাকী ১% মূলত ইহুদী ও খ্রিস্ট ধর্মাবলবম্বী। মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ৭০% শিয়া মতাবলম্বী। বাকীরা সুন্নী। অমুসলিম বিদেশীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন মতাবলম্বী ছাড়াও হিন্দু, বাহাই, বৌদ্ধ, শিখ, ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী আছে।
যোগাযোগব্যবস্থা
[সম্পাদনা]খাদ্য
[সম্পাদনা]বাহরাইনে প্রচলিত কিছু সাধারণ খাবারঃ
- বালালীত, (আরবি: بلاليط) - মিষ্টি জাফরানের নুডলস যার উপরে অমলেট দেওয়া থাকে।
- বেইথ এল্গিট্টা, (আরবি: بيض القطا) - বাদামের গুঁড়া ও চিনি দিয়ে তৈরী ভাজা বিস্কুট। এক ধরণের ডিমের আকৃতির হওয়ায় একে সেই ডিমের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
- বিরিয়ানী, (আরবি: برياني) – একটি সাধারণ খাবার যা খুব মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। প্রধান উপাদান চাল সঙ্গে থাকে মুরগী অথবা ভেড়া বা ছাগল।
- ফিরগা - সাদা চাল যা টমেটো, আলু এবং বেগুন দিয়ে রান্না করা হয়।
- গ্যাবাউট (আরবি: قبوط), ঘন মাংসের ঝোলে মেশানো আটা দিয়ে তৈরী করা হয়।
- গার্স ওগালি (আরবি: قرص عقيلي), একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা যা ডিম, ময়দা, চিনি এবং জাফরান দিয়ে তৈরী করা হয়। প্রথাগতভাবে চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
- ঘুরাইবা - আটা, ঘি, চিনি গুঁড়ো এবং এলাচ মিশিয়ে তৈরী করা এক ধরণের বিস্কুট যা সাধারণত আরবীয় কফির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
- হারেস, (আরবি: هريس) - গম মাংসের সঙ্গে রান্না করে পেষা হয় উপরে এক ধরণের চিনি ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
- জিরেশ (আরবি: يريش), - মুরগী বা বকরী, টমেটো এবং মশলা দিয়ে রান্না করে মিশ্রিত করে তৈরী করা হয়।
- খাবেস, (আরবি: الخبيص) - আটা ও তেল সহযোগে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবার।
- লুগাইমাত, (আরবি: لقيمات) - জাফরান সিরাপে ডোবানো ঈষ্টের ভাজা পিঠা। চিনি, লেবু এবং জাফরান দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।
- মাকবুশ, (আরবি: مجبوس) - ছাগল, মুরগী বা মাছ দিয়ে তৈরী খাবার যার উপরে সুগন্ধি চাল ছড়ানো থাকে এবং মুরগী বা ছাগলের মশলা যুক্ত ঝোল দিয়ে রান্না করা হয়।
- মাহ্যোয়া, (আরবি: مهياوة) - এক ধরণের মাছের সস।
- মাগলুবা, (আরবি: مقلوبة) - মাংস, আলু এবং বেগুন দিয়ে রান্না করা হয়।
- মারগুগ, (আরবি: مرقوق) - সব্জির স্ট্যু যাতে সাধারণত স্কোয়াশ এবং বেগুন থাকে।
- মুমাওয়াশ, (আরবি: مموش) - চাল সবুজ ডাল দিয়ে রান্না করা হয় এবং উপরে শুকনো চিংড়ি দেওয়া হয়।
- মুতাব্বাক সামাক, (আরবি: مطبق سمك) - ভাতের উপর পরিবেশিত মাছ। অধিক মশলাযুক্ত মাছের ঝোল দিয়ে ভাত রান্না করা হয়।
- কুজি, (আরবি: قوزي) - বাহরাইনি ভেড়ার রোস্ট যা ভাত, মাংস, ডিম এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাজানো থাকে।
- জালাবিয়া, (আরবি: زلابية) - একধরণের জিলাপী যা চিনি, লেবু ও জাফরানের দ্রবণ বা সিরাপে চুবিয়ে তৈরী করা হয়।
পানীয়
[সম্পাদনা]কাহওয়াহ এদের জাতীয় পানীয়। তবে অতিথি আপ্যায়নে চা পরিবেশন করা হয়। অন্যান্য পানীয়ের মধ্যে আছে লবন, দইয়ের পানীয় এবং কোমল পানীয়। সীমাবদ্ধ ভূমির কারণে বাহরাইন খুবই অল্প পরিমাণ খাবার উৎপাদন করে এবং বাকি খাবার এরা আমদানী করে থাকে।