বিবাদী বাগ, পুরো নাম বিনয়-বদল-দীনেশ বাগ, কলকাতার ঔপনিবেশিক আমলের এলাকা। একদা ডালহৌসি স্কোয়ার বা কেবল ডালহৌসি নামে পরিচিত এই এলাকা আপনাকে সেই ব্রিটিশ আমলে নিয়ে যাবে, যখন ভারত ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত। লালদীঘিকে কেন্দ্র করে গঠিত এই এলাকা ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের শাসনকেন্দ্র ছিল, আর শহরের প্রাচীন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা হিসাবে এখানে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ও সরকারি ভবন রয়েছে।
অনুধাবন
[সম্পাদনা]বাংলায় ব্রিটিশদের আগমনের সময় তারা এখানে বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কারণ এটি অন্যান্য পাড়ার তুলনায় কম জনবহুল ছিল। সেখানে তারা ফোর্ট উইলিয়াম তৈরি করেছিল, তবে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর তারা গোবিন্দপুরে নতুন ফোর্ট উইলিয়াম তৈরি করেছিল। আদি ফোর্ট উইলিয়ামের জায়গায় এখন জেনারেল পোস্ট অফিস রয়েছে। যাইহোক, তৎকালীন ডালহৌসি কলকাতার "হোয়াইট টাউন"-এর কেন্দ্র ছিল। তখন ধনী বা দরিদ্র কোনো স্থানীয়রা সেখানে বসবাসের সাহস পায়নি। তারা দিনের বেলায় এখানে কাজের জন্য আসত আর সূর্যাস্তের আগে তারা "ব্ল্যাক টাউন"-এ (বর্তমান উত্তর কলকাতা) ফিরে যেত।
লালদীঘিকে কেন্দ্র করে ডালহৌসি গড়ে উঠেছিল। লালদীঘির নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। এক মত অনুযায়ী, দোল অনুষ্ঠানের সময় এই দিঘির রং লাল হয়ে যেত, তাই এর নাম "লালদীঘি" হয়েছিল। আরেক মত অনুযায়ী, পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ামের লাল রঙর প্রতিফলনের জন্য এই দিঘির রং লাল দেখাত। লালদীঘির উত্তরদিকে রাইটার্স বিল্ডিং (বর্তমান মহাকরণ) ও তার চারিদিকে একাধিক কার্যালয় থাকার ফলে ডালহৌসি কলকাতার বণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, যা স্থানীয় ভাষায় "অফিস পাড়া" নামেও পরিচিত। ১৯৩০-এর দশকে বিনয়, বাদল ও দীনেশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেছিলেন, যার ফলে অলিন্দ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সেই ঘটনার স্মরণে ভারতের স্বাধীনতার পর ডালহৌসির নাম "বিনয়-বদল-দীনেশ বাগ" বা "বিবাদী বাগ" রাখা হয়েছিল।
এই নিবন্ধে মূলত লালদীঘির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ধারের এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পূর্ব ধারের জন্য ধর্মতলা দেখুন।
প্রবেশ
[সম্পাদনা]মেট্রোতে
[সম্পাদনা]মহাকরণে ২ নং মেট্রো লাইনের স্টপেজ রয়েছে, আর এই লাইন হাওড়া ও ধর্মতলাকে সংযুক্ত করে।
লোকাল ট্রেনে
[সম্পাদনা]চক্ররেলের মাধ্যমে বিবাদী বাগে পৌঁছনো যায়। 1 বিবাদী বাগ চক্ররেল ও 2 ইডেন গার্ডেন চক্ররেল স্টেশনে লোকাল ট্রেন দাঁড়ায়।
নৌকায়
[সম্পাদনা]- 3 আউটরাম ঘাট, স্ট্র্যান্ড রোড। নদীতীরে কলকাতার অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে দূরে হলেও এখানে বিদ্যাসাগর সেতুসহ নদীর বিস্তৃত দৃশ্য পাওয়া যায়। এখানে একাধিক খাবারের দোকান রয়েছে। অন্যান্য ঘাটের মতো এই ঘাটও স্নান ও ধর্ম অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- 4 ফেয়ারলি ঘাট, স্ট্র্যান্ড রোড।
- 5 বাবুঘাট, ৮ স্ট্র্যান্ড রোড। কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত খেয়াঘাট। ১৮৩০ সালে স্বর্গীয় স্বামীর স্মরণে রানী রাসমণি এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে একটি সুউচ্চ ঔপনিবেশিক স্থাপনা রয়েছে, তবে লোকারণ্যের ফলে আদিকালের সেই শ্রী নেই। হাওড়া, বালি ইত্যাদি ঘাট থেকে খেয়া পরিষেবা রয়েছে। বিনামুূল্যে।
দেখুন
[সম্পাদনা]- 1 কলকাতা উচ্চ আদালত, এসপ্ল্যানেড রো ওয়েস্ট (টাউন হল ও স্ট্র্যান্ড রোডের মাঝে), ☎ +৯১ ৩৩ ২২৫৪ ৮০০০, ফ্যাক্স: +৯১ ৩৩ ২২৪৮ ৭৮৩৫, ইমেইল: calcuttahighcourtprotocol@gmail.com। ১৮৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রাচীনতম উচ্চ আদালত, যা আজও বিভিন্ন কিংবদন্তি আইনি লড়াইয়ের সাক্ষী। ভবনটি গথিক স্থাপত্যশৈলীতে এবং হুবহু বেলজিয়ামের ইপ্রেসের স্টাডহান্সের আদলে নির্মিত।
- 2 জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও), নেতাজি সুভাষ রোড। বৃহৎ গম্বুজ ও সুউচ্চ করিন্থিয়ান স্তম্ভের জন্য পরিচিত এই ভবন ১৮৬৮ সালে পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ামের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। তার পর থেকেই এটি শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হয়ে আসছে।
- 3 বিধানসভা ভবন, এসপ্ল্যানেড রো ওয়েস্ট। এখানে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা আয়োজিত হয়।
- 4 মহাকরণ (রাইটার্স বিল্ডিং), ১৬ বিবাদী বাগ উত্তর। কলকাতার এক বিখ্যাত প্রশাসনিক ভবন, যাঁর নকশাকার টমাস লায়ন। ১৭৭৭-১৭৮০ সালে নির্মিত এই ভবন আগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্নশ্রেণির কেরানিদের কার্যালয় ছিল। ১৯৩০ সালে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাইটার্স বিল্ডিং হামলা করেছিলেন, যা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় থেকে এটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ অধিকারিকদের কার্যালয় ছিল। ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবরে মহাকরণ পুনর্জীবন প্রকল্পের নামে সেখানকার কার্যালয়সমূহ হাওড়ার নবান্নে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যার ফলে এটি এক দশকের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থায় পড়ে থাকে। শোনা যায় যে রাতে মহাকরণে ভূতের উপদ্রব ঘটে, আর সেখানে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণের ঘটনা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
- 5 রাজভবন (প্রাক্তন নাম: লাটভবন)। ১৮০৩ সালে ইংল্যান্ডের কেডলস্টোন হলের আদলে এটি নির্মিত, যা ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর-জেনারেল ও পরে ভাইসরয়ের বাসস্থান ছিল, আর উভয়ই তৎকালীন সময় বাংলা ভাষায় "বড়লাট" নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সাল থেকে এটি বঙ্গের ও পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসস্থান হয়ে আসছে। জনগণের জন্য উন্মুক্ত এই ভবনে একাধিক বিরল শিল্পকর্ম রয়েছে।
ধর্মস্থান
[সম্পাদনা]- 6 আর্মেনীয় গির্জা, ২ আর্মেনিয়ান স্ট্রিট। ১৭২৪ সালে নির্মিত আর্মেনীয় অ্যাপোস্টলিক গির্জা।
- 7 তাজাউং (ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের কাছেই, শহরতলি: ইডেন গার্ডেন চক্ররেল )। এক ক্ষুদ্র হ্রদের কাছে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা। ১৮৫৪ সালে লর্ড ডালহৌসি বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে এই প্যাগোডা এনেছিলেন।
- 8 ম্যাগেন ডেভিড সিনাগগ, ১০৯ ক্যানিং স্ট্রিট। ভিক্টোরীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই ভবন পূর্ব ভারতের বৃহত্তম সিনাগগ। ১৮৮৪ সালে ডেভিড জোসেফ এজরার স্মৃতিতে এলিয়াস ডেভিড এজরা এর নির্মাণ করেছিলেন।
- 9 সেন্ট অ্যান্ড্রু গির্জা, ১৫ বিবাদী বাগ উত্তর।
- 10 সেন্ট জন গির্জা, ২/১ কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, ☎ +৯১ ৩৩ ২২৪৩ ৬০৯৮, ইমেইল: stjohnschurchcni@gmail.com। ১৭৮৭ সালে নির্মিত এই গির্জা কলকাতা তৃতীয় প্রাচীনতম গির্জা ও শহরের প্রাচীনতম অ্যাংলিকান গির্জা। এর চত্বরে একাধিক সমাধি রয়েছে, যার মধ্যে জব চার্নকের সমাধি উল্লেখযোগ্য।
জাদুঘর
[সম্পাদনা]- 11 কলকাতা টাউন হল, ৪ এসপ্ল্যানেড রো ওয়েস্ট। ১৮১৩ সালে ডরিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই ভবনে বর্তমানে একটি জাদুঘর ও একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। জাদুঘরে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ইতিহাস রয়েছে। গ্রন্থাগারে কলকাতা বিষয়ক বিরল গ্রন্থের ভাণ্ডার রয়েছে, যা কেরলবাসী পি. টি. নায়ারের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়েছিল। পি. টি. নায়ার কলকাতা মহানগরীকে এত ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কলকাতায় কাটিয়েছিলেন, তারপর তিনি কেরলে ফিরে এসেছিলেন।
- 12 কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট জাদুঘর, জিএফ, ফেয়ারলি ওয়্যারহাউস, ৬ স্ট্র্যান্ড রোড (শহরতলি: বিবাদী বাগ চক্ররেল )। সোম-শুক্র ১০:০০ পূর্বাহ্ণ–৪:৩০ অপরাহ্ণ। কলকাতা বন্দরের ঐতিহ্য বিষয়ক জাদুঘর। এখানে বন্দরের বিভিন্ন বিখ্যাত জাহাজের প্রতিরূপ রয়েছে।
- 13 মেটকাফ হল, ১২ স্ট্র্যান্ড রোড। নিওক্লাসিকাল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি ঔপনিবেশিক ভবন। এর একতলায় এশিয়াটিক সোসাইটির বিরল বিদেশি পত্র বিভাগ ও দোতলায় ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের কার্যালয়, প্রদর্শনী চিত্রশালা ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
- 14 ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জাদুঘর, ৮ কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, ইমেইল: therbimuseum@rbi.org.in। ভারতের মুদ্রাব্যবস্থা বিষয়ক জাদুঘর। এখানে বিনিময় প্রথা থেকে কড়ি হয়ে কাগুজে মুদ্রা, ধাতব মুদ্রা, শেয়ার বাজার ও ডিজিটাল লেনদেন পর্যন্ত দেশের মুদ্রাব্যবস্থার ইতিহাস বিষয়ক প্রদর্শনী রয়েছে। এর ভবনটি আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কার্যালয় ছিল, যা পরে ১৫ নেতাজি সুভাষ রোডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
করুন
[সম্পাদনা]- 1 ইডেন গার্ডেন (শহরতলি: ইডেন গার্ডেন চক্ররেল )। ভারতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনকারী ক্রিকেট মাঠের মধ্যে একটি। লর্ড অকল্যান্ডের ভগিনীর নামানুসারে স্টেডিয়ামটির নাম "ইডেন গার্ডেন" রাখা হয়েছে। এটি বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএ) এবং ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর) দলের গৃহ স্টেডিয়াম।
- 2 নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম (শহরতলি: ইডেন গার্ডেন চক্ররেল )। ১৯৭৫ সালে উদ্বোধিত এই ভবনের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১২,০০০ জন। এখানে খেলাধূলা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই বিভিন্নরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
- 3 মিলেনিয়াম পার্ক, স্ট্র্যান্ড রোড। নদীতীরে এক সুন্দর উদ্যান, যা ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত। কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) দ্বারা নির্মিত এই উদ্যান নদীর সুন্দর দৃশ্যের জন্য পরিচিত। সেখানে নদীর চারিদিকে একাধিক খেয়া-নৌকা ঘুরে বেরায়।
রাত্রিযাপন
[সম্পাদনা]মূলত বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক এলাকা হওয়ার দরুন বিবাদী বাগের মধ্যে রাত্রিযাপন সম্ভব নয়। তবে পার্শবর্তী শহর বিভাগে রাত্রিযাপনের একাধিক সুযোগসুবিধা রয়েছে।
- 1 পোলো ফ্লোটেল, ১০ স্ট্র্যান্ড রোড, ☎ +৯১ ৩৩ ২২১৩-৭৭৭৯।
মোকাবেলা
[সম্পাদনা]থানা
[সম্পাদনা]- 1 কলকাতা পুলিশ সদর দপ্তর, লালবাজার, ☎ +৯১ ৩৩ ২২১৪ ৩০২৪, +৯১ ৩৩ ২২১৪ ৩২৩০, +৯১ ৩৩ ২২১৪ ১৩১০।