চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত একটি ছোট শহর। হুগলি নদী তীরে অবস্থিত এই শহরটি অন্যান্য শহরের থেকে এক আলাদা পরিচয় বজায় রেখেছে। "স্বাধীনতার শহর" চন্দননগর তার বর্ণনাতীত সৌন্দর্য্যের জন্য সর্বদা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষদের আকর্ষিত করে এসেছে। এর মোট আয়তন মাত্র ১৯ বর্গকিমি ও জনসংখ্যা ১৫০ হাজারের মতো হলেও চন্দননগর কেবল ভারতের মানচিত্রে নয়, সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একটি অনন্য স্থান দখল করেছে।
জানুন
[সম্পাদনা]৩০০ বছর ধরে চন্দননগরে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক নিজস্ব মিশ্রণ বর্তমান, যা ইতিহাসে অতুলনীয়। এই শহরটি রেলপথ, সড়কপথ ও নদীপথের মাধ্যমে কলকাতার সঙ্গে সংযুক্ত, এবং সেখানে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। ইতিহাস জুড়ে চন্দননগরের ব্যক্তিগণ সাহিত্য ও শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও কলায় যুক্ত হয়ে এসেছে। এই শহরে একাধিক দর্শনীয় স্থান আছে, যেমন জাদুঘর, স্ট্র্যান্ড, গির্জা, মন্দির, রবীন্দ্র ভবন, বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিদের জন্মস্থান এবং অন্যান্য অনেক দর্শনীয় স্থান, যাদের মধ্যে সব স্থান খুব পরিচিত নয় কিন্তু পর্যটক ও ইতিহাসবিদ উভয়কে মনোরঞ্জিত করে।
প্রবেশ
[সম্পাদনা]আকাশপথে
[সম্পাদনা]নিকটতম বিমানবন্দর হলো কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (CCU আইএটিএ), যা ভারতের সমস্ত শহর এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শহরের সঙ্গে আকাশপথে সংযুক্ত। বিমানবন্দর থেকে চন্দননগর কেবল ৪০ কিমি দূরে। চন্দননগর থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ট্যাক্সি ভাড়া করা। ট্যাক্সির ভাড়া প্রায় ₹১০০০–₹২,০০০ এবং ট্র্যাফিক অনুযায়ী বিমানবন্দরে যেতে প্রায় ১.৫–২ ঘণ্টা লাগবে।
রেলপথে
[সম্পাদনা]মেন লাইন হয়ে হাওড়া বা বর্ধমান থেকে প্রচুর লোকাল ট্রেন পাওয়া যায় (প্রতি ১০ বা ১২ মিনিটে একটি ট্রেন)। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এক্সপ্রেস ও প্যাসেঞ্জার ট্রেন এখানে দাঁড়ায়। হাওড়া থেকে আপনি বর্ধমান (মেন লাইন), ব্যান্ডেল, কাটোয়া, মেমারী বা পাণ্ডুয়াগামী লোকাল ট্রেন ধরতে পারেন। লোকাল ট্রেনের টিকিটের মূল্য ₹৮ (একমুখী)। সকাল ও বিকালের ব্যস্ত সময়ে লোকাল ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় হয়।
চন্দননগরে দুটি রেলওয়ে স্টেশন আছে, প্রধান 1 চন্দননগর স্টেশন ও ছোট 2 মানকুণ্ডু স্টেশন। এক্সপ্রেস ট্রেন ও ব্যস্ত সময়ের পরিষেবা সাধারণত মানকুণ্ডুতে দাঁড়ায় না, কিন্তু প্যাসেঞ্জার ও লোকাল ট্রেন সেখানে দাঁড়ায়।
ঘুরে দেখুন
[সম্পাদনা]রিকশা করে
[সম্পাদনা]রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে আপনি একাধিক রিকশাচালকদের অপেক্ষা করতে ও আপনাকে ডাকতে দেখবেন। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলুন। সমগ্র শহর ঘোড়ার জন্য ₹১৫০-এর বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। যতটা পারেন আপনি দর কষাকষি করুন। বিকালে আপনি রিকশা থেকে নেমে চন্দননগর স্ট্র্যান্ডে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
চন্দননগরে প্রচলিত বিভিন্ন রিকশার মধ্যে অটোরিকশার পরিষেবা দুর্দান্ত। আপনি চন্দননগর বা মানকুণ্ডু স্টেশন ও স্ট্র্যান্ডের মধ্যে অটো ভাড়া করতে পারেন। এদের দর অত্যন্ত কম (প্রায় ₹৬–১০) এবং সাধারণত আপনাকে একদল লোকের মধ্যে ভ্রমণ করতে হবে (ধরুন ৪ থেকে ৫ জন)। সাধারণত এই অটোগুলি নির্ধারিত পথে ঘুরে বেড়ায়, তবে নিজের কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছনোর জন্য আপনি ব্যক্তিগতভাবে অটো ভাড়া করতে পারেন।
দেখুন
[সম্পাদনা]- 1 দুপ্লে প্যালেস (Dupleix Palace)। সমগ্র অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো ও শ্রেষ্ঠ জাদুঘর। এই জাদুঘরে বিভিন্ন সুন্দর ফরাসি সামগ্রীর সঙ্কলন বর্তমান (যেমন: ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান, অষ্টাদশ শতাব্দীর কাঠের আসবাব ইত্যাদি), যা বিশ্বের অন্যত্র পাওয়া দুষ্কর। এখনও এই প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শ্রেণির মাধ্যমে ফরাসি ভাষা শেখানো হয়।
- 2 পাতাল বাড়ি। এই বাড়িটি আগেকার সময়ের ব্যক্তিদের উন্নত স্থাপত্য ও নান্দনিক জ্ঞানের পরিচায়ক। এর সবচেয়ে নিচু তলটি হুগলি নদীর তলায় অবস্থিত। নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই এই বাড়িতে আসতেন এবং এর প্রশংসা করতেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে এই জায়গাটি তাঁকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল এবং এটি তাঁর বুদ্ধিগত দক্ষতাকে প্রসারিত করেছিল। বিভিন্ন উপন্যাসে তিনি পাতাল বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই বাড়িতে থেকেছিলেন।
- 3 ফরাসি কবরস্থান, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (লালদিঘির বিপরীতে)। ফরাসি কবরস্থানে ১৫০টি কবর আছে। যেসব খ্যাতনামা ব্যক্তিদের এই ফরাসি কবরস্থানে সমাধি দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দুপ্লেসিস (ফরাসি চন্দননগরের প্রতিষ্ঠাতা) এবং আবহবৈজ্ঞানিক হেনরি "স্টর্ম" পিডিংটন, যাঁর নাম অমিতাভ ঘোষের দ্য হাঙরি টাইড উপন্যাসে উল্লেখ করে হয়েছে।
করুন
[সম্পাদনা]- 1 চন্দননগর স্ট্র্যান্ড। হুগলি নদী বরাবর নিপুণভাবে সজ্জিত পাকা রাস্তা, যার দুদিক আলো ও সবুজ গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১ কিমি ও প্রস্থ ৭ মিটার, এবং এই রাস্তার দুদিকে অজস্র ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনা বর্তমান। এটি স্থানীয় ব্যক্তি ও পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত সুন্দর বেড়ানোর জায়গা, যাঁরা এই রাস্তা বরাবর ঘুরে বেড়িয়ে মৃদু বাতাস উপভোগ করা এবং পাশ দিয়ে ছোট নৌকা চলে যাওয়া দেখতে ভালবাসেন। এখনকার পরিবেশ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চন্দননগরের থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "অনন্ত এ আকাশের কোলে, টলমল মেঘের মাঝার, এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর, তোর তরে কবিতা আমার।" এই স্ট্র্যান্ড বরাবর বিবেকানন্দ মন্দির (উপাসনা কেন্দ্র) এবং দুর্গাচরণ রক্ষিত মেমোরিয়াল বর্তমান।
উৎসব
[সম্পাদনা]চন্দননগর তার জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত। এটি দুর্গাপূজার এক মাস পরে পালিত হয়, সাধারণত নভেম্বর মাসে। প্যান্ডেল, রাস্তার আলো, প্রতিমা–সবকিছুই আপনাকে অবাক করবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ লোক এই সময়ে আসেন। ভিড় সহ্য না হলে আপনি এই সময় চন্দননগর এড়িয়ে যেতে পারেন।
বড়দিন উদ্যাপনের সময়ও চন্দননগরে ভিড় হয়। চন্দননগরের বড়বাজারের মাঝে একটি বহু পুরনো গির্জা আছে এবং সমস্ত ধর্মের ব্যক্তিদের কাছে এটি বড়দিনের প্রধান আকর্ষণ।
কিনুন
[সম্পাদনা]আহার
[সম্পাদনা]পানীয়
[সম্পাদনা]শহর জুড়ে মদের দোকান পাওয়া যায়, যেখানে আপনি দেশি-বিদেশি বিভিন্নরকম মদ পেতে পারেন। কিছু শুঁড়িখানাও সেখানে পাওয়া যেতে পারে। চন্দননগর একদা তার ঘরোয়া মদ্যশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল, এবং এটি রেলপারে এখনও বেআইনিভাবে পরিচালিত হয়। সেখানে অবশ্য না যাওয়াই ভাল, আপনি জানবেন না আপনার সঙ্গে কী হতে পারে। এছাড়া জনবহুল জায়গায় মদ্যপান না করাই ভাল, যেহেতু লোকে একে ভাল চোখে দেখবে না।
রাত্রিযাপন
[সম্পাদনা]চন্দননগরে ভাল হোটেলের অভাব রয়েছে। শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময় আপনাকে অনেক আগে থেকে হোটেল ভাড়া করতে হবে। এছাড়া আপনি চুঁচুড়ায় হোটেল ভাড়া করে চন্দননগর যেতে পারেন।
- 1 রবীন্দ্র ভবন গেস্ট হাউস, স্ট্র্যান্ড রোড। চন্দননগর পৌরসংস্থা দ্বারা পরিচালিত, এক সুন্দর রাত্রিযাপনের জায়গা।
পরবর্তী গন্তব্য
[সম্পাদনা]- হুগলি-চুঁচুড়া — প্রাক্তন পর্তুগিজ-ওলন্দাজ উপনিবেশ, ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়া ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক ভবনের জন্য পরিচিত।