হুগলি-চুঁচুড়া বা হুগলী-চুঁচুড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার সদর দপ্তর। এটি কলকাতার ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এবং বাংলার ইতিহাসে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান বর্তমান।
জানুন
[সম্পাদনা]হুগলি-চুঁচুড়া পৌরসভা আদতে ব্যান্ডেল, হুগলি ও চুঁচুড়া এই তিন শহর নিয়ে গঠিত। ব্যান্ডেল ও হুগলি ১৫৮০ থেকে ১৬২৯ পর্যন্ত পর্তুগিজদের উপনিবেশ ছিল এবং চুঁচুড়া ১৬২৬ থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত ওলন্দাজদের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, একমাত্র ব্যান্ডেল চার্চ ও ওলন্দাজ কবরস্থান ছাড়া এই তিন শহরে অব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিহ্ন তেমন নেই।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]১৫৩৬ সালে পর্তুগিজ বণিকেরা এই এলাকায় বাণিজ্য করার জন্য তৎকালীন বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করেছিলেন। ১৫৭৯ ও ১৫৮০ সালের মধ্যে তৎকালীন মুঘল সম্রাট আকবর পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন পেদ্রো তাভারেসকে বাংলার যেকোনো জায়গায় একটি শহর পত্তনের অনুমতি দিয়েছিলেন। পর্তুগিজরা এর জন্য হুগলি (পর্তুগিজ: Ugulim উগুলিঁ) বেছেছিল এবং এটি বাংলার প্রথম ইউরোপীয় বসতিতে পরিণত হয়েছিল। কয়েক দশকের মধ্যে হুগলি বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দরে পরিণত হয়েছিল।
১৫৮০ সালে ক্যাপ্টেন পেদ্রো তাভারেস সম্রাটের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি লাভ করেছিলেন। এর ফলে ১৫৯৯-এ ব্যান্ডেল গির্জা তৈরি করা হয়েছিল, যা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো গির্জার মধ্যে অন্যতম। ১৬২৯ সালে হুগলি শহরে এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল এবং বাংলার মুঘল গভর্নর পর্তুগিজদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেল গির্জাকেও পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। ১৬৬০ সালে গোমেজ দ্য সোতো ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন গির্জা তৈরি করেছিলেন।
১৬৫৬ সালে ওলন্দাজরা নিকটবর্তী চুঁচুড়ায় একটি কারখানা স্থাপন করেছিল। কিন্তু ১৬৮৫ সালে ইংরেজ কুঠিয়াল ও মুঘলদের মধ্যে বিবাদের জন্য কারখানাকে বোমা দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। ১৭৪০ সালে ঐখানে ফোর্ট গুস্টাভুস নামক একটি দুর্গ স্থাপন করা হয়েছিল, যা পরে গভর্নরের বাড়ির সঙ্গে ধ্বংস করা হয়েছিল।
১৬৯০ সালে জব চার্নক ব্রিটিশ বাণিজ্য কেন্দ্রকে হুগলি থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে কলকাতার নিরাপদ অবস্থান এবং বঙ্গোপসাগরের নৈকট্যের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য হুগলি থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়েছে এবং হুগলি তার গুরুত্ব লোপ পেয়েছিল।
১৭৫৯ সালে চন্দননগরে পদযাত্রার সময় চুঁচুড়ার ওলন্দাজ বাহিনী এক ব্রিটিশ বাহিনীর উপর আক্রমণ করেছিল। চুঁচুড়ার যুদ্ধ আধ ঘণ্টার কম সময় ধরে ঘটেছিল এবং ওলন্দাজ আক্রমণকারীদের ছত্রভঙ্গের ফলে এই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ১৭৯৫ সালে এক ব্রিটিশ বাহিনী এই শহরের দখল নিয়েছিল। যদিও ১৮১৪-এর ইঙ্গ-ওলন্দাজ চুক্তির মাধ্যমে ওলন্দাজ তার চুঁচুড়া পুনরায় লাভ করেছিল, ১৮২৫ সালে ওলন্দাজরা ভারতে তাদের সমস্ত উপনিবেশ ব্রিটিশদের দান করেছিল।
প্রবেশ
[সম্পাদনা]আকাশপথে
[সম্পাদনা]নিকটতম বিমানবন্দর হচ্ছে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (CCU আইএটিএ)।
রেলপথে
[সম্পাদনা]হুগলি-চুঁচুড়ায় চারটি রেলওয়ে স্টেশন বর্তমান: ব্যান্ডেল জংশন, চুঁচুড়া, হুগলি ও হুগলি ঘাট।
1 ব্যান্ডেল জংশন হচ্ছে এখানকার প্রধান রেলওয়ে স্টেশন এবং হাওড়া–বর্ধমান মেন, ব্যান্ডেল–কাটোয়া ও ব্যান্ডেল–নৈহাটি রেলপথের সংযোগস্থল। এই রেলপথ দিয়ে যাতায়াতকারী বহু এক্সপ্রেস ট্রেন ব্যান্ডেলে থামে। অদ্ভুতভাবে, স্টেশনটির প্রধান বাহির পথ মূল শহরের বিপরীতে অবস্থিত এবং মূল শহরে আসতে আপনাকে স্টেশন রোড ধরে রেল সুড়ঙ্গ দিয়ে যেতে হবে। এই রাস্তাটি ব্যান্ডেল মোড়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে মিলিত হয়।
2 চুঁচুড়া ও 3 হুগলি স্টেশন হাওড়া–বর্ধমান মেন রেলপথে অবস্থিত এবং ভারতের সবচেয়ে পুরনো রেলওয়ে স্টেশনের অন্যতম। ১৫ আগস্ট ১৮৫৪-এ হাওড়া ও হুগলির মধ্যে পূর্ব ভারতের প্রথম বাণিজ্যিক রেল পরিষেবা চালু হয়েছিল।
4 হুগলি ঘাট স্টেশনটি ব্যান্ডেল ও নৈহাটিকে সংযোগকারী রেলপথে অবস্থিত।
গাড়িতে
[সম্পাদনা]হুগলি-চুঁচুড়া কলকাতার সঙ্গে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ও ওল্ড দিল্লি রোড দ্বারা সংযুক্ত। তবে হুগলি-চুঁচুড়ায় যাওয়ার জন্য ওল্ড দিল্লি রোডে করে যাওয়াই ভাল, কারণ স্থানীয় ট্র্যাফিকের জন্য গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে প্রায়ই যানজট দেখা দেয় এবং ভাঙাচোড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো সহজ নয়।
ঘুরে দেখুন
[সম্পাদনা]বিভিন্ন স্টেশন ও প্রধান দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অটোরিকশা, মিনিবাস ও সাইকেল রিকশা বর্তমান। আপনি স্টেশন থেকে নেমে অটো করে ইমামবাড়া, ব্যান্ডেল গির্জা ও ওলন্দাজ কবরস্থান দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন।
দেখুন ও করুন
[সম্পাদনা]- 1 ওলন্দাজ কবরস্থান, চুঁচুড়া। চুঁচুড়ায় কিছু অবশিষ্ট অব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিহ্নের মধ্যে অন্যতম। এটি ভারতের সবচেয়ে পুরনো কবরস্থানের মধ্যে অন্যতম। এটি ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ দ্বারা সংরক্ষিত।
- 2 চুঁচুড়ার ঘড়ি টাওয়ার (ঘড়ির মোড়), চুঁচুড়া। ব্রিটিশ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডকে উৎসর্গ করে নির্মিত।
- 3 ব্যান্ডেল গির্জা (ব্যান্ডেল চার্চ, ব্যান্ডেল বাসিলিকা), ব্যান্ডেল। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো গির্জার মধ্যে অন্যতম, এবং এটি বাংলায় পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক দিনের এক স্মৃতিচিহ্ন। এটি আওয়ার লেডি অব দ্য রোজারিকে উৎসর্গ করে নির্মিত। বর্তমান গির্জাটি ১৬৬০ সালে গোমেজ দ্য সোতো নির্মাণ করেছিলেন।
- 4 লাহিড়ী বাবা আশ্রম (আধারালয়), ওল্ড দিল্লি রোড, রাজহাট (ব্যান্ডেল জংশনের পশ্চিমে)। পূর্বাহ্ন ১০:০০–মধ্যাহ্ন এবং অপরাহ্ন ৪:০০–৬:০০। এই মন্দিরটি তার স্থাপত্যকলা ও পরিবেশের জন্য পরিচিত এবং এটি যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর দর্শনের উপর ভিত্তি করে ২০০৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল। এটি জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য খোলা। এই মন্দিরটি হচ্ছে রাজস্থানি ও দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের স্থাপত্যের মিশ্রণ। এর প্রবেশদ্বার অর্থাৎ গোপুরমটি চমৎকার। মূল মন্দিরটি ছাড়াও এই আশ্রম এলাকায় বিভিন্ন মন্দির বর্তমান। শুধু তাই নয়, সেখানে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের জন্য পৃথক প্রার্থনা ঘর বা নামাজঘর বর্তমান। এই আশ্রম চত্বরটির উভয়দিক প্রাচীন আমগাছ ও ফুলবাগানে ভর্তি। বিনামূল্যে।
- 5 শরৎচন্দ্র স্মৃতি মন্দির, দেবানন্দপুর (ব্যান্ডেল জংশন থেকে ২ কিমি পশ্চিমে)। বাংলা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৪–১৯৩৮) জন্মভূমি। তাঁর রচিত বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্প বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এমনকি রূপালী পর্দাতেও শরৎচন্দ্রের গল্পকাহিনী ফুটে উঠেছে। সেখানে শরৎচন্দ্র পাঠাগার নামক একটি সংগ্রহশালা বর্তমান, যেখানে শরৎচন্দ্র যেসব জিনিস ব্যবহার করেছিলেন তার সংগ্রহ আছে।
- 6 সুসান্না আন্না মারিয়া সৌধ, চুঁচুড়া। এটি নিওক্লাসিকাল ও বারক স্থাপত্যের এক মিশ্রণ এবং সুসান্না আন্না মারিয়াকে (মৃত্যু ১৮০৯) উৎসর্গ করে নির্মিত। তিনি দুবার বিবাহ করেছিলেন, একবার বাংলার ওলন্দাজ পরিচালককে এবং পরে এক ইংরেজ ব্যবসায়ীকে। তবে এক প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী সুসান্নার সাত স্বামী ছিল, যার ভিত্তিতে রাস্কিন বন্ডের উপন্যাস সুসান্নাজ সেভেন হাজবেন্ডস ও হিন্দি চলচ্চিত্র সাত খুন মাফ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এই কাহিনীর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
জুবিলি ব্রিজ ও সম্প্রীতি সেতু
[সম্পাদনা]7 জুবিলি ব্রিজ হচ্ছে ব্যান্ডেল ও নৈহাটির মধ্যে সংযোগকারী এক প্রাক্তন রেলসেতু। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫-এ রানি ভিক্টোরিয়ার ৫০ বছরের রাজত্ব (গোল্ডেন জুবিলি) উপলক্ষ্যে এই সেতুটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই সেতুটি ১২৯ বছর ধরে পরিচালিত হয়েছিল এবং বহু প্রজন্ম হুগলি নদী পারাপারের জন্য এই সেতুটি ব্যবহার করেছিলেন। এই সেতুটি হুগলি নদীর উপর প্রথম স্থায়ী সেতু, যে নদীকে তখন দুর্গম ভিত্তি স্থাপনার জন্য সেতুর অযোগ্য বলে মনে করা হয়েছিল।
২০১৬ সালে এই সেতুটির পাশে সম্প্রীতি সেতু নামক নতুন সেতু তৈরি করা হয়েছিল, যা ভারতের প্রথম কন্টিনিউয়াস ট্রাস ব্রিজ। এর ফলে পুরনো জুবিলি ব্রিজ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
কিনুন
[সম্পাদনা]বিশেষ করে ২০০০ সালের পরে ব্যান্ডেল, হুগলি ও চুঁচুড়ায় বিভিন্ন শপিং মলের উদ্বোধন করা হয়। বিদেশি বাজারের তুলনায় এখানে জিনিসপত্র সস্তা, বিশেষ করে পাইকারি দ্রব্য কেনার সময়। উপহারের জন্য ভাল হস্তশিল্পের জিনিসপত্র কিনতে পারেন।