রাতারগুল বাংলাদেশের একটি দর্শনীয় স্থান, যা সিলেট জেলার অন্তর্গত। এটি দেশের রাজধানী ঢাকা হতে ৩১৫ কিমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলায় অবস্থিত যা ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এবং ২০১৫ সালে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় ‘মুর্তা’ বা পাটি গাছ “রাতা গাছ” নামে পরিচিত; এই রাতা গাছের নামানুসারে এ বনের নাম “রাতারগুল জলারবন”।
বিশেষত্ব[সম্পাদনা]

সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে সারি - গোয়াইন নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি হাওর: শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর। সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার।
এই জলারবনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে “বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ২০৪.২৫ হেক্টর বনভুমিকে ৩১ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর “বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা” হিসাবে ঘোষণা করে। এটি পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি। এই বনকে বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগের অধীনে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
চিরসবুজ এই বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। গোয়াইন নদী সারি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং চেঙ্গির খালের সাথে একে সংযুক্ত করেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম- Millettia pinnata)। বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে। বর্ষাকালে এই বনে অথৈ জল থাকে চার মাস। তারপর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ। আর তখন পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণীকুল।
সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্রান্তীয় জলবায়ুর এই বনটিতে প্রতিবছর ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বনের সবচাইতে কাছে অবস্থিত সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্যমতে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪১৬২ মিলিমিটার; জুলাই মাসটি সবচাইতে আর্দ্র যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিহীন সবচাইতে শুষ্ক মাসটি হল ডিসেম্বর। মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ৩২° সেলসিয়াসে, আবার জানুয়ারিতে এই তাপমাত্রা নেমে আসে ১২° সেলসিয়াসে। ডিসেম্বর মাসে এখানকার আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টে ৯০ শতাংশেরও বেশি।

বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এই মিঠাপানির জলাবনটিতে উদ্ভিদের দু'টো স্তর পরিলক্ষিত হয়। উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান। বনের উদ্ভিদের চাঁদোয়া সর্বোচ্চ ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত। বনের স্বাস্থ্য সন্তোষজনক। এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ বেত, কদম, হিজল, মুর্তা সহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ; আছে পিঠালি অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম, বট গাছও।
জলমগ্ন বলে এই বনে সাঁপের আবাস বেশি; আছে জোঁকও। শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায় এখানে। এছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ। পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁস সহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি; আসে বিশালাকায় শকুনও। মাছের মধ্যে আছে টেংরা, খলিসা, রিটা, পাবদা, মায়া, তল্লা আইড়, কালবাউশ, রুই সহ বিভিন্ন জাত।
জলে নিম্নাংঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটকগণ। বনের ভিতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় নৌকার, তবে সেগুলো হতে হয় ডিঙি নৌকা ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা। তবে বনে ভ্রমণ করতে অনুমতি নিতে হয় রাতারগুল বন বিট অফিস থেকে।
কীভাবে যাবেন[সম্পাদনা]

রাতারগুল যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে সিলেটে। সিলেট শহর থেকে রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে।
প্রথম উপায়: সিলেট থেকে জাফলং–তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হয়, ভাড়া ৯০০-১৫০০ এর মধ্যে (আসা-যাওয়া) আর সময় লাগে ২ ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হয়, এতে ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০-৩০০ টাকা।
দ্বিতীয় উপায়: সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো, ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট–শালুটিকর হয়ে যাওয়া এই রাস্তাটা বর্ষাকালে বেশ উপভোগ্য। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৮০০–১৫০০ টাকার মধ্যে (আসা-যাওয়া) এবং সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হয়, এতে মাঝি ঘণ্টাপ্রতি খরচ পড়বে ২০০-৩০০ টাকা।
তৃতীয় ও সহজ উপায়: সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মোটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছাতে হবে, ভাড়া নেবে ২০০-৩০০ টাকা এবং সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এরপর মোটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়, ভাড়া পড়বে ৮৫০ টাকা। একটি ডিঙ্গি নৌকায় সর্বোচ্চ ৬ জন উঠা যায়।
এছাড়া জলাবনে প্রবেশের জন্য বন বিভাগের কাউন্টারে প্রবেশ ফি হিসেবে জন প্রতি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৫৭.৫০ টাকা ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২৮.৭৫ টাকা জমা দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়।
কোথায় থাকবেন[সম্পাদনা]
গোয়াইনঘাটে থাকার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের কিছু হোটেল ও রেস্ট হাউস থাকলেও তুলনামূলক মানসম্মত রেস্ট হাউস ও মোটামুটি মানের হোটেল রয়েছে বিভাগীয় সদর সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজার শরীফের পার্শ্ববর্তী এলাকায়, যেখানে ৪০০ থেকে ২,০০০ টাকায় বিভিন্ন ধরণের রুম পাওয়া যায়। এছাড়াও থাকার জন্য উন্নতমানের কিছু হোটেলও রয়েছে -
- হোটেল রোজভিউ ইন্টারন্যাশনাল (৫ স্টার) : উপশহর, সিলেট; ☎ ০৮২১-৭২১৮৩৫, ২৮৩১২১৫০৮-১৪, ২৮৩১৫১৬-২১, মোবাইল: ০১১৯৫১১৫৯৬৪, ইমেইল- sales@roseviewhotel.com, reservation@roseviewhotel.com
- হোটেল ফরচুন গার্ডেন : জেল রোড, সিলেট, ☎ ০৮২১-৭১৫৫৯০, ৭২২৪৯৯, ফ্যাক্স: ০৮২১-৭১৫৫৯০, মোবাইল: ০১৭১১-১১৫১৫৩, ইমেইল- info@hotelfortunegarden.com, ওয়েব: www.hotelfortunegarden.com
- হোটেল ডালাস : তামাবিল রোড, মিরাবাজার, সিলেট, ☎ ০৮২১-৭২০৯৪৫, ৭২০৯২৯, ইমেইল- hoteldallassylhet@yahoo.com, ওয়েব: www.hoteldallassylhet.com
- হোটেল সুপ্রিম : তামাবিল রোড, মিরাবাজার, সিলেট, ☎ ০৮২১-৮১৩১৬৯, ৭২০৭৫১, ৮১৩১৭২, ৮১৩১৭৩, ফ্যাক্স: ০৮২১-৮১৩১৭১, মোবাইল: ০১৭১১-১৯৭০১২, ০১৬৭৪-০৭৪১৫৭, ইমেইল- hotelsupreme_1@yahoo.com, hotelsupreme_2@hotmail.com
- হোটেল হিলটাউন : ভিআইপি রোড, তেলি হাওড়, সিলেট, ☎ ০৮২১-৭১৮২৬৩, মোবাইল:- ০১৭১১৩৩২৩৭১, ৭১৬০৭৭, ওয়েব: www.hiltownhotel.com
- নাজিমগড় রিসোর্ট : ☎ ০৮২১-২৮৭০৩৩৮-৯, ওয়েব: www.nazimgarh.com
কী খাবেন[সম্পাদনা]
রাতারগুলের আশেপাশে ভালো খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। মোটরঘাটে কিছু টি-স্টল বা হালকা নাস্তা করার মত দোকান আছে। ভালো মানের খাবারের জন্য সিলেট শহরে আসতে হবে। এছাড়া যাওয়া আসার পথে রাস্তার ধারে কিছু খাবারের দোকান রয়েছে।
পরবর্তিতে যান[সম্পাদনা]
- লালাখাল-রাতারগুল থেকে ফতেহপুর-হরিপুর-তামাবিল সড়ক হয়ে ৩৭ কিলোমিটার দূরে সোয়া এক ঘণ্টায় দূরত্বে অবস্থিত লালাখালে।
- জাফলং-সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে, যা এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।